হেফাজতের পরবর্তী আমির কে হবেন তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু

 
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত‌্যুর পরপরই অরাজনৈতিক সংগঠনটির পরবর্তী আমির কে হবেন, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। পরিবর্তন আসছে কওমি মাদরাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং উচ্চতর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’এর চেয়ারম্যান পদেও।
গত শুক্রবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দাফন শেষে আছর নামাজের পর মাদ্রাসার মজলিসে সুরার বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ আহমদ সাহেব ও মাওলানা ইয়াহইয়া সহ তিন সদস্য বিশিষ্ট মজলিসে আমেলা গঠন করা হয়। একই বৈঠকে হেফাজাতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে শাইখুল হাদীস ও নাযেমে তালিমাত বা শিক্ষা সচিব মনোনীত করা হয়।
এছাড়াও মাওলানা হাফেজ শোয়াইবকে সহকারী শিক্ষা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনের সময় মাদ্রাসায় ভাংচুরের ঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব কমিটি ও প্রতিষ্ঠানে থাকা একাধিক শিক্ষক ও নেতা জানান, আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি এবং বড় ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা, প্রচার ও প্রসারে প্রবীণ এ আলেমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের আমির পদে দুই বাবুনগরীর নাম আসছে ঘুরেফিরে। তারা হলেন- হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমির মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
 
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশপরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে আহমদ শফীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে নিজেকে সংগঠন থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসায়ও আর আসেননি। কিন্তু গত শনিবার রাতে তিনি মজলিসে শূরার বৈঠকে উপস্থিত হন। দুই বাবুনগরীর পাশাপাশি আমির হিসেবে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীর নামও আলোচনায় রয়েছে।
মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের আগে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। শাপলা চত্বরের জমায়েতপরবর্তী সময়ে সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সমঝোতারও বিরোধিতা করেন তিনি। অন্যদিকে ওই সময় মৌখিকভাবে পদত্যাগ করেছিলেন মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তবে লিখিত না হওয়ায় ওই পদত্যাগের ঘোষণা কার্যকর হয়নি।
এ অবস্থায় দুই বাবুনগরীর অনুসারীরা মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকেই হেফাজতে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দেখতে চান। ইতোমধ্যে তারা এমন দাবিও তুলেছেন।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আমি হেফাজতের মহাসচিব হিসেবে আছি। নতুন আমির কিংবা পরবর্তী যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কাউন্সিল ডাকা হবে। কাউন্সিলে যে সিদ্ধান্ত আসবে, সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই হেফাজতের কার্যক্রম চলবে।
এদিকে হাটহাজারীর বাইরেও উঠেছে হেফাজতে ইসলামের নতুন আমির পদের দাবি। ঢাকার চারিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমীকেও হেফাজতে ইসলামের আমির করার দাবি তুলেছে হেফাজতের একটি অংশ। গত শুক্রবার পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর শাহ আহমদ শফীকে চারিয়া মাদ্রাসায় নিয়ে গোসল দেয়া হয়। সেখানে কাফনের কাপড় পরানো হয়।
টানা ৭০ বছর শিক্ষকতার পাশাপাশি হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় ৩৫ বছর মুহতামিম বা মহাপরিচালক ছিলেন শাহ আহমদ শফী। মৃত্যুর আগের দিন এ প্রতিষ্ঠান থেকে তার কর্তৃত্বের পুরোপুরি অবসান হয়। তবে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক) এখনো শফীর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে আছে। জীবদ্দশায় শাহ আহমদ শফী বেফাকের চেয়ারম্যান ছিলেন। মহাসচিব ছিলেন ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মহাপরিচালক মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। পরে আহমদ শফী তাকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব দেন। শফীর অনুপস্থিতিতে এখন তিনিই কার্যত বেফাকের চেয়ারম্যান। দুই বাবুনগরীর কেউ বেফাকের সঙ্গে যুক্ত নন।
দেশের কওমি মাদ্রাসার অনেকেই ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামী ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তবে হেফাজতে ইসলামের আমির প্রয়াত শাহ আহমদ শফী ও মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত এমন নেতাদের হেফাজতের আমির ও মহাসচিব হওয়ার রেওয়াজ নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে কওমি ঘরানার বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম গড়ে তোলেন হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী। কওমি ঘরানার সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলকে এক ব্যানারে নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। ১৩ দফা দাবি দিয়ে ২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল ঢাকা অবরোধ ও রাজধানীর শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে আলোচনায় আসেন আহমদ শফী।
এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলে খবরের শিরোনাম হন। পরবর্তী সময়ে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কওমি সনদের স্বীকৃতি আদায় করেন তিনি। ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আহমদ শফীর পদত্যাগ এবং তার ছেলে আনাস মাদানীকে বিভিন্ন অভিযোগে মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কারসহ ৫ দফা দাবি নিয়ে দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে।