জন্মশতবর্ষে এমএ আজিজ তোমার কথা হেথা কেহ ত বলে না-নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা » এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা এ আর চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, ইউনুস খান, মওলানা ছালে জহুর প্রভৃতি যাঁরা পঞ্চাশের দশকের ঊষাকালে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন করেছিলেন, তাঁরা চল্লিশের দশকে ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, গোরা আজিজ, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে মুসলিম লীগ করতেন। এঁরা সব মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের কর্মী। সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৯৪৭) দু’বছরের মধ্যে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি বিরোধী দল গঠনের উদ্যোগ নিলেন, তার আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের জন্য ২৩ জুন পুরোনো ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাশ লেনে ঢাকা পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান কাজী বশির হুমায়ুনের ‘রোজ গার্ডেন’ হলরুমে একটি কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়েছিলো। সেই কাউন্সিলে চট্টগ্রাম থেকে ১১ জন যোগদান করেছিলেন বলে প্রচার আছে, প্রথমোক্ত ৯ জনের তাতে যোগদানের সম্ভাবনা বেশি। কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের ছাত্রনেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং গোরা আজিজও তাতে যোগদানের জন্য ঢাকা গিয়েছিলেন, কিন্তু ফ কা চৌধুরী ঢাকা গেলেও সম্মেলনে যান নি। গোরা আজিজ যোগ দিলেও দিতে পারেন, কারণ সে সম্ভাবনা ছিলো।
৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর দু’এক মাসের মধ্যেই চট্টগ্রামেও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো। মুসলিম লীগ অধ্যুষিত চট্টগ্রামের বন্ধুর, রুক্ষ মাটিতে কুসুমিত আওয়ামী রাজনীতির ফুল ফোটানো সহজসাধ্য ছিলো না। তার প্রত্যক্ষ কারণ হলো ভাগাভাগিতে মুসলিম লীগের পাল্লা ভারি পড়েছিলো। ফজলুল কাদের চৌধুরী ছাড়াও আরো যাঁরা মুসলিম লীগে থেকে গিয়েছিলেন তারা হলেন আবুল খায়ের সিদ্দিকী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, ছাতি মফিজ, আলিমুল্লাহ চৌধুরী, সুলতান আহমদ, দেওয়ান সুলতান ও উকিল সুলতান, আবদুল জলিল চৌধুরী, ক্যাপ্টেন বখতেয়ার, সিরাজুল হক টি.কে. পেঁচু মিয়া। এরা ছাড়াও প্রবীণ মুসলিম লিগ নেতাÑরফিক মিয়া, নূর আহমদ চেয়ারম্যান, খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী, খান বাহাদুর মিঞা খান সওদাগরÑরা তো ছিলেনই। তাছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফ কা চৌধুরীর পোষা লাঠিয়াল বাহিনীও ছিলো।
তবুও বৈরি অবস্থার মধ্যেও এক সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ চট্টগ্রামের মাটিতে শিকড় গাড়তে সক্ষম হয়। এমএ আজিজ ছিলেন শক্ত গড়নের সাহসী মানুষ। হালিশহরের মানুষের মারপিটের জন্য খ্যাতি ছিলো। এমএ আজিজ হালিশহরের কিছু মানুষের সমর্থন পেয়েছিলেন। তাছাড়া তাঁর পরিবারও প্রভাবশালী ছিলো। নানা কারণে এমএ আজিজই নতুন দলের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য সামনে এসে দাঁড়ান। তাঁকে সামনে নিয়ে শুরু হলো চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের পথচলা। প্রথমে একটিই কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি-উত্তর ও দক্ষিণে বিভক্ত চট্টগ্রামের বর্তমান দুই সাংগঠনিক জেলা, কক্সবাজার মহকুমা এবং তিন পার্বত্য জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করে এক বিশাল জেলা। এমএ আজিজ হলেন সাধারণ সম্পাদক এবং পাকিস্তান আন্দোলনে ন্যাশনাল গার্ডের জেলা কমান্ডার শেখ মোজাফফর আহমদকে করা হলো সভাপতি। ৪৯ সাল এই কমিটি দিয়েই কাজ চললো। ৫০ সালে শহর আলাদা করে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আর একটি কমিটি গঠন করা হলোÑযার সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সভাপতি বাংলা বাজারের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী বর্ষিয়ান আমীর হোসেন দোভাষ।
অতঃপর মানুষকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালো।
এমএ আজিজ ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম জেলার বঙ্গোপাসগর উপকূলীয় এলাকা হালিশহরে জন্মগ্রহণ করেন। এ হিসেবে এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। কিন্তু সেটা সম্ভবত কেউ মনে রাখেননি। যে কারণে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য কোন উদযোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীও।
ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রধান নেতা, হোক তাঁর বাড়ি চট্টগ্রাম, কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তো তাঁকে তাঁর বন্ধু এবং তাঁকে ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, তাই তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে দলের কোন কর্মসূচি থাকবে না এটা হতে পারে না। জেলায় অবস্থান করে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেও এমএ আজিজ তাঁর অতুলনীয় প্রজ্ঞা এবং ব্যক্তিত্ব দিয়ে কেন্দ্রের রাজনীতি ও সাংগঠনিক নীতি-কৌশল নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারতেন, কখনো কোনো দলীয় সিদ্ধান্তকে ভুল মনে হলে তিনি তাতে হস্তক্ষেপ করে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে সেই ভুল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতেন বলেই এটা সম্ভব হতো। এখানে আমরা কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে কিভাবে এমএ আজিজ আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণে ভূমিকা পালন করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বিকাশে সহায়তা করেছেন, তা’ দেখানোর চেষ্টা করবো।
প্রথমত, সোহরাওয়ার্দী সাহেব ১৯৬২ সালে তৎকালীন বিরোধী দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে এন.ডি.এফ নামে একটি জোট গঠন করেন এবং আওয়ামী লীগকে উক্ত জোটভুক্ত করে দলের সাংগঠনিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত করেন। এমএ আজিজের মনে হয়েছিলো নেতার এই সিদ্ধান্ত ঠিক হলো না। তিনি এনডিএফ-এ যোগদান থেকে বিরত থাকেন এবং তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাÐে সক্রিয় থাকার জন্য ‘ডেমোক্র্যাটিক ওয়ার্কার্স ফ্রন্ট’ নামে একটি সংগঠন গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও এনডিএফ-এ আওয়ামী লীগের বিলুপ্তির পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু নেতার সিদ্ধান্তের বিরোধিত করা তাঁর সমীচীন মনে হয়নি। তাই তিনি মেনে নিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের জহুর আহমদসহ সকলে মেনে নিয়েছিলো। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর প্রথম সুযোগেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করে এনডিএফ থেকে বেরিয়ে আসেন।
দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি ৬ দফা, যা-ঘোষণা করার পর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এই কর্মসূচি থেকেই জনমানসে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবধারা উৎপন্ন হয় এবং বাঙালি জাতিসত্তা সংহত রূপ ধারণ করে। ৬ দফার পর জাতীয় রাজনীতির যে মেরুকরণ হয়, তা’ দ্রæত স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তোলে।
এমএ আজিজ বঙ্গবন্ধু’র জীবনের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মসূচি ৬ দফাকে আইয়ুব খান যাতে অঙ্কুরেই পিষে মেরে ফেলতে না পারে, সেজন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান থেকে একমাত্র তিনিই সর্বপ্রথম ৬দফাকে সমর্থন করে চট্টগ্রাম থেকে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন। কারণ তাঁর আশঙ্কা হয়েছিলো, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রæয়ারি লাহোরে কপ-এর চেয়ারম্যান চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু ৬দফা পেশ করেছিলেন। সে বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বিরোধী দলীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। ৬দফাকে সমর্থন দূরের কথা, তারা কেউ ৬দফা নিয়ে আলোচনা করতেও সম্মত হন নি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনে সে কর্মসূচি উপস্থাপনের পর তা’ একমাত্র ইত্তেফাক পত্রিকায় ছোট একটি সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখন ৬দফাকে সমর্থন করে কোন বক্তৃতা বিবৃতি প্রকাশিত না হলে ৬দফা কোণঠাসা হয় পড়বে। মনে হবে ৬দফার প্রতি কোন জনসমর্থন নেই। আর এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে আইয়ুব-মোনায়েম বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনতে পারে।
এসব কথা ভাবনাচিন্তা করেই এমএ আজিজ চট্টগ্রাম থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে ৬দফাকে প্রথম সমর্থন দান করেছিলেন। তাঁর অনুরোধে চট্টগ্রামের আরো চারজন বিশিষ্ট নেতাও উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। তাঁরা হচ্ছেন-আবুল কাশেম সাবজজ, আবদুল্লাহ আল হারুন, এমএ হান্নান ও একেএম আবদুল মন্নান।
তৃতীয়ত বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর সরকারের ধরপাকড়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ দিয়ে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতা ‘পিডিএম’ নামে একটি নতুন দল গঠন করে ১৯৬৭ সালের ২ মে ৬ দফার বিপরীতে ৮ দফা ঘোষণা করে। প্রবীণ নেতা আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বে পিডিএমপন্থীরা ৬ দফার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে এবং আওয়ামী লীগে সংকট সৃষ্টি হয়। আগস্ট মাসে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন সহ ১৮ জন সদস্য জেলে। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে পিডিএমপন্থীরা ১৪ আগস্ট একটি রিকুইজিশন সভা আহবার করে। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম তলবী সভা অবৈধ ঘোষণা করে ১৯ আগস্ট ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। এই কাউন্সিলে এমএ আজিজ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পিডিএমপন্থীদের বহিষ্কারের প্রস্তাব দেন। এতে কাউন্সিলে গোলযোগ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত আপস ফর্মূলা হিসেবে ১৪ জন পিডিএমপন্থী নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কাউন্সিলে ৮দফা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং ৬ দফা গৃহীত হয়। এমএ আজিজ ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের সাহায্যে ছাত্রলীগের জঙ্গী কর্মীদের দিয়ে চারিদিক থেকে ইডেন হোটেল ঘেরাও করে বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টি করে রাখেন যাতে ভেতরের পরিবেশ ৬দফা-পন্থীদের অনুকূলে থাকে।
গণতান্ত্রিক উপায়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোতে বাঙালির অধিকার আদায়, ক্ষমতা লাভ এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসানের কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে বঙ্গবন্ধু গোপনে সশস্ত্র বৈপ্লবিক উপায়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা চালান। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলেও ৯২ ক ধারা জারি করে সে সরকারকে বাতিল করে দেয়া হয়Ñচোখের সামনেই এসব ঘটনা ঘটতে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু নিজেও ঐ নির্বাচনে জিতেছিলেন। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তানকে প্রথম একটি সংবিধান উপহার দিয়েছিলো এবং যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করেছিলো। কিন্তু প্রধানত পাঞ্জাবী সামরিক-অসামরিক আমলারা বাঙালি নেতৃত্বের উত্থান লক্ষ করে শংকিত হয়ে পড়ে এবং এক রাতের আঁধারে পাকিস্তানি জেনারেলরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেয়। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধু গোপনে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এমনি এক বড় বিপ্লবী পরিকল্পনা হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও জওয়ানদের দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে একযোগে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অবাঙাপলি সেনাদের বন্দি করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা। কিন্তু একজন সদস্যের বিশ্বাসঘাতকায় সে পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধুসহ পরিকল্পনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে ‘আগতরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ রুজু করা হয়। এই মামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এমএ আজিজ এ সময় চট্টগ্রামে ‘মুজিব দিবস’ পালন করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে তীব্র আন্দোলন ও জনমত গড়ে তুলেছিলেন। আগরতলা মামলার ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি ‘মুজিব ফান্ড’ গঠন করে তার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।
৬দফা বাস্তবায়ন ও আগরতলা মামলা বাতিল-এই দুই দাবি যুক্ত হয়ে ৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রচÐ গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিলো। আইয়ুব খান এই আন্দোলনে নতি স্বীকার করে ১ ফেব্রæয়ারি গোলটেবিলে বৈঠক আহবান করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে যোগদানের জন্য প্যারালে মুক্তি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। এমএ আজিজ বুঝতে পেরেছিলেন আইয়ুবের উদ্দেশ্য হলো আগরতলা মামলা বাতিল ও বন্দি মুক্তির মূল দাবিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। এমএ আজিজ বঙ্গবন্ধুকে গোলটেবিলে বৈঠকে যোগদান না করার অনুরোধ জানান এবং বেগম মুজিবকে দিয়েও তিনি প্রভাব খাটিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত করতে না পারলেও বৈঠকের শূন্য ফলাফলে বঙ্গবন্ধু নিজে ফিরে এসে হতাশ প্রকাশ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ন্যায় এমএ আজিজও গণতান্ত্রিক রাজনীতি করলেও বহুদিন থেকে মনে মনে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন লালন করতেন। আমি নিশ্চিত জানি ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করে ভারতের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে এমএ আজিজ যুক্ত ছিলেন। ৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ ‘নিউক্লিয়াস’ নামে ক্যাডারভিত্তিক যে গোপন সংগঠন গঠন করেছিলেন, তাঁরা পরে স্বীকার করেছেন এমএ আজিজ তাঁদের পরামর্শদাতা দিলেন। নিউক্লিয়াসের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
এমএ আজিজ চট্টগ্রামের ইতিহাসের দ্রæত পরিবর্তনশীল ঘটনাবহুল সময়ে বর্তমান ছিলেন। তিনি একই সঙ্গে ইতিহাসের সাক্ষী ও নির্মাতা। যে কারণে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতেন এবং যা’ তাঁর বিপুল খ্যাতির উৎস, সেটি হচ্ছে তিনি স্বাধীনতার কথা সবার আগে বলেছিলেন। সেজন্য তিনি এক দফার প্রবক্তা হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে আছেন।
৬৯ সালে মিরসরাই থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় এমএ আজিজ বলেছিলেন, “সরকার ৬ দফা মেনে না নিলে জনগণ ১ দফার তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম আরম্ভ করবে।’’ এই ঘোষণার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে আটকাদেশ দেয়া হয়েছিলো।
১৯৭০ সালে কাট্টলীর এক জনসভায় তিনি আবার ঘোষণা করেন ‘যদি ৬ দফা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে আমরা এক দফার আন্দোলন করবই।’
এভাবে তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে বলতে শুরু করেছিলেন। সত্তরের প্রথমভাগে কক্সবাজার পাবলিক হলে এক কর্মী সম্মেলনে তিনি কর্মীদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন ‘সরকার যদি ৬ দফা না মানে তাহলে কি করবেন? জবাবের জন্য সামান্য একটু প্রতীক্ষা, তারপর দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সুস্থির ঘোষণা হয় ‘ছয় দফা না মানলে এক দফার আন্দোলন শুরু হবে।’
ঢাকায় ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিনে উষ্ণ সংবর্ধনায় সিক্ত হতে হতেও চট্টল শার্দুল এমএ আজিজ রুদ্র মূর্তিতে উচ্চারণ করেছিলেন আরো ভয়ংকর বোমা : ‘If you (Pakistani Junta) have the right to exceed, we shall have the right to secede.’ এটি ছিলো একটি দুঃসাহসী বক্তব্য; এতে স্পষ্টতই বিচ্ছিন্নতার হুমকি ছিলো।
তিনি “৬ দফা না মানলে ১ দফা” এই সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে স্পষ্টতই জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকেই মূর্ত করে তুলেছিলেন। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর পরে স্বাধীনতায় যদি অন্য কারো অবদান অনুসন্ধান করতে হয়, তাহলে দেখা যাবে সেখানে এমএ আজিজের নামই জ্বলজ্বল করছে।
স্বাধীনতা যদি এম এ আজিজের প্রথম অবদান হয়, তাহলে তাঁর দ্বিতীয় অবদান হলো তিনি চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছিলেন। চট্টগ্রামের সার্ধশত বছরের (১৮৭৫-২০২০) রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক মহান নেতার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন ১৮৭৫ সাল অর্থাৎ চিটাগাং এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা-বর্ষকে যদি চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিচর্চার যাত্রাবিন্দু ধরি, তাহলে যেসব নাম স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ান, তাঁরা হলেন, যাত্রামোহন সেন, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, মাস্টারদা সূর্য সেন প্রভৃতি নেতৃবর্গ। আধুনিক রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের উদ্বোধনে ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, মহাকবি নবীনচন্দ্র সেন, উকিল দুর্গাদাস দস্তিদার ও কমলাকান্ত সেন, গুয়াতলীর প্যারীমোহন চৌধুরী, আনোয়ারার নেটিভ ডাক্তার রামকিনু দত্ত, ভাটিখাইনের কেদারনাথ দাশগুপ্ত ও ‘চট্টলগৌরব’Ñখ্যাত মহিম চন্দ্র দাশ, ধোরলার ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী প্রমুখের অবদানও স্মরণীয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মাদার্শায় হালদা নদীর টেক কাটা আন্দোলনের নেতৃত্বদান থেকে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এমএ আজিজ যুগের আরম্ভ। তারপর একে একে মূলনীতি বিরোধী আন্দোলন, টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচন, রোজগার্ডেন সম্মেলনে যোগদান করে আওয়ামী লীগ গঠনে ভূমিকা গ্রহণ এবং বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে এমএ আজিজকে প্রত্যক্ষ করে চট্টগ্রামের মানুষ একজন নতুন নেতার আবির্ভাবে সচকিত হয়ে ওঠে। তারও আগে ১৯৪৯ চট্টগ্রামে যখন প্রথম এম এ আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়, তখনই চট্টগ্রামে যে একজন নতুন নেতার অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে, তারই প্রথম প্রকাশ ঘটেছিলো। শুভপুর থেকে টেকনাফ, তিন পার্বত্য জেলা, এমনকি চট্টগ্রাম শহরও নিয়ে গোটা চট্টগ্রামে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের একটিই কমিটি গঠিত হয়েছিলো, এমএ আজিজই যার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী বছর শহরের জন্য আলাদা কমিটি হলে জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্ব পরিস্ফূট হয়ে ওঠে।
এম এ আজিজ ১৯৪৯-এ যে রাজনীতির সূচনা করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি তাঁর জীবনান্ত পর্যন্ত যার অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বহমান ছিলো, এই সময়ের মধ্যে একজন ব্যতিক্রমী নেতা হিসেবে তাঁর উত্তরণই শুধু আমরা প্রত্যক্ষ করি না, একই সঙ্গে তিনি চট্টগ্রামের রাজনীতিকে আবার জাতীয়তাবাদী অসাম্পদ্রায়িক ধারায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
ঢাকায় যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগই ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলো এবং যার কারণে সেটা সম্ভব হয়েছিলো, তিনি হচ্ছেন এমএ আজিজ। তিনি তখন অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিলো, তার নেতৃত্ব নিয়ে দু’ধরনের মত প্রচলিত আছে। একটি মতে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী এবং আহবায়ক এম এ আজিজ ও চৌধুরী হারুনুর রশিদ যুগ্ম আহবায়ক; অপর মতানুসারে এমএ আজিজ আহবায়ক এবং মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও চৌধুরীর হারুনুর রশিদ যুগ্ম আহবায়ক। এমএ আজিজের জীবনীকার শরীফ শমসির লিখেছেন প্রথমে আহবায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন মফিজুল ইসলাম (অধ্যক্ষ)। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে এমএ আজিজকে আহবায়ক পদে নির্বাচিত করা হয়। আহবায়ক যুগ্ম আহবায়ক যাই হোক না কেন, এমএ আজিজই অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের। এই কমিটি গঠনের জন্য যে মিটিং হয়েছিলো, সেটাও আওয়ামী লীগ অফিসেই হয়েছিলো। তখন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ এবং ডা. আনোয়ার হোসেন-রাও ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্বের ভূমিকায় সক্রিয় ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন : এমএ আজিজ রাজনৈতিক জীবনে বারে বারে যে সাহস, বলিষ্ঠতা, দৃঢ়তা এবং আপসহীন সংগ্রামী মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, তার একটি সম্ভাব্য কারণ এই হতে পারে যে, তিনি একটি নাবিক পরিবারে জন্মেছিলেন। সমুদ্র অভিযাত্রী নাবিকরা শুধুমাত্র বুকের সাহসটুকু সম্বল করে বাণিজ্যের পসরা নিয়ে দূর দূর সমুদ্রে তাদের ডিঙা ভাসিয়ে দিতেন। সেই সাগরের কোন কুল-কিনারা নাই-চারিদিকে শুধু অথৈ পানি, যাতে হাঙর-কুমিরের বাস; পানিতে প্রচÐ আলোড়ন তুলে পাহাড় সমান উথাল পাতাল ঢেউয়ের অবিশ্রান্ত গর্জন। চরম সাহসী মানুষের বুকও ভয়ে কেঁপে যায়। শুধু স্থির, অকম্প, অচল থাকেন বহুদিনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ নাবিকরা। যারা হাঙর-কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে পেশীবহুল হাতে ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যান এক বন্দর থেকে আরেক বন্দরে। সমুদ্রে জীবন বাজি ধরে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হয়।
এমনি এক সাহসী নাবিকের উত্তর পুরুষ, উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি রক্তে লাভ করেন প্রলয়ের দোলা; তিনি যখন পূর্ব পুরুষের নাবিকের পেশা ত্যাগ করে রাজনীতিকে করে তোলেন কর্মক্ষেত্রে এবং পরাধীনতার গ্লানি মুচিয়ে দেশমাতার মুখে হাসি ফোটানোর ব্রত গ্রহণ করেন, তখন তিনি তো সংগ্রাম ও সাহসের প্রতীক হয়ে উঠবেনই। এমএ আজিজ জন্মালেন এমন একটি বছর, যে বছরটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সংগ্রামেরই অনন্য মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। সে বছর মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেবেন, কিন্তু তার আগেই বিপ্লবী চট্টগ্রাম দেশপ্রিয় জেএম সেনগুপ্তের ডাকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে ধর্মঘট ও বুলক ব্রাদার্স জাহাজ ধর্মঘটের মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিলো। যার ফলে গান্ধীজী নতশিরে চট্টগ্রামকে অভিবাদন জানিয়ে বলেছিলেন “Chittagong to the fore”. সেই বছরেই, ১৯২১ সালে, জাহাজিদের বাসস্থান হালিশহরের এক জাহাজি তোরাব আলীর অন্তঃপুরে তাঁর পুত্র মহব্বত আলীর স্ত্রী রহিমা খাতুনের উদর ছিড়ে ভূমিষ্ঠ একটি নবজাগতের রোদনভরা আতর্নাদ ধ্বনিত হলো। বলা বাহুল্য মহব্বত আলী সদ্যোজাত শিশুটির পিতা এবং রহিমা খাতুন মাতা। এই শিশুটিই উত্তরকালের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিক এমএ আজিজ।
মহব্বত আলীর পিতা অর্থাৎ এমএ আজিজের পিতামহের নাম হাজি তোরার আলী। তিনি জাহাজের মালুম, যাঁর কথা আমরা বললাম। হাজি সাহেবের তিন পুত্র ও এক কন্যা। তাঁর ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য বলা মুস্কিল, তাঁর পুত্ররা কেউ নাবিকের পেশা গ্রহণ করলো না। ফলে তাঁর পরিবারে তিনিই শেষ জাহাজি হয়ে ইতিহাস হয়ে থাকেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুর রহমান হন কোর্টের মুন্সি; দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্র যথাক্রমে আবদুল গণি ও এমএ আজিজের পিতা মহব্বত আলী সরকার সেকালের অনেক চট্টগ্রামীর মতো বার্মার দিকে ধাবিত হন। আবদুল গণি সেখানে চাকরিজীবী ছিলেন। মহব্বত আলী বার্মায় ‘স্টীল ব্রাদার্স’ নামক একটি ব্রিটিশ চাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সেখানে অর্ধশত বছর চাকরি করেন। মহব্বত আলীর তিন বছর বযসে পিতা তোরাব আলী মরিশাসে এক জাহাজডুবিতে ইহলীগা সংবরণ করেন।
মহব্বত আলী বার্মায় চাকরি করে প্রভৃত অর্থের অধিকারী হন। তিনি ১৯২৪ সালে হালিশহরে ফিরে এসে বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। ১৯২৮ সালে স্বীয় জমিতে স্বীয় অর্থ ব্যয় করে একটি স্কুল স্থাপন করেন। মাটির ঘরের ওপর টিনের ছাউনি দিয়ে নির্মিত স্কুলের নামকরণ করা হয়- “মধ্যম হালিশহর চৌচালা প্রাইমারি মক্তব’। মহব্বত আলীর পাঁচ সন্তান, তন্মধ্যে কন্যাই প্রথম, তারপর চারপুত্র। কন্যা নাম আম্বিয়া খাতুন। চার পুত্র যথাক্রমে এমএ আজিজ, এমএ মজিদ, এমএ হালিম ও মো. ইউনুস।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এম এ আজিজ ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪২ সালে প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৪৪ সালে স্নাতক শ্রেণির ছাত্র অবস্থায় তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। এম এ আজিজ ১৯৪০-এ মুসলিম ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যোগদান করে পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আজীবন তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ডবলমুরিং আসন থেকে এম এন এ নির্বাচিত হন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা