আজ চট্টগ্রাম নগরীর চেরাগি, মোমিন রোডে তরুন উদ্যোগের আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ।বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন সার্থকহবে না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং রাষ্ট্রকে জাতীয় চার মূলনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত করার দাবি উঠেছে চট্টগ্রামের এক সমাবেশ থেকে।
‘রুখো সাম্প্রদায়িকতা, রুখো মৌলবাদ, জাগাও বিবেক- রামু থেকে গোবিন্দগঞ্জ, নাসিরনগর থেকে শাল্লা। এই বর্বরতার শেষ কোথায়?’ এই স্লোগান নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের আয়োজনে অনুষ্ঠিত নাগরিক মানববন্ধন ও সমাবেশে এসব দাবি জানান বক্তারা।
আজ ২১ মার্চ রবিবার নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে চট্টগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণি পেশা, রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।
সমাবেশে কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমাদের দাঁড়াতে হচ্ছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা অংশ নিয়েছিলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। সেই লড়াইয়ের ফসল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু এমন একটি সংবিধান করেছিলেন যাতে ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি বলতে হয় ধর্মের কথা। বাংলাদেশ চিরকাল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। অসাম্প্রদায়িক উত্তরাধিকার বহন করে বাংলাদেশের জন্ম। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে। পশ্চিমাদের সকল পুর্বাভাষ মিথ্যা করে বাংলাদেশ উন্নত দেশের যাত্রায় রয়েছে। পাশাপাশি দু:খের হলো যে, বাংলাদেশে যে সমাজ রাষ্ট্র গড়ার লড়াই করা দরকার যেন প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। যাতে সংখ্যালঘু বলে কেউ বঞ্চনার শিকার না হয়। খোদ সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক যাদের হাইব্রিড বলছেন তাদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই যে বাংলাদেশের স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সে দেশ আমরা পাব। আত্মপরিচয়ের জন্য হাজার বছরের ঐতিহ্য রক্ষায় যে যুদ্ধ আমরা করেছিলাম তা যেন হারিয়ে না যায়। তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবছার বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথা আজ বারবার চলে আসে। একাত্তরে আমরা মৃত্যুর পরোয়া না করে যুদ্ধ করেছি। চার বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিতে হয়েছে। যে বাঘা যতীনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই বাঘা যতীনের ভাস্কর্য কে ভাঙল? দিরাই শাল্লা নাসিরনগরে কারা হামলা করল?তারা কারা?কেন এসব হামলায় সরকারি দলের লোকের নাম আসে?শাল্লার ঘটনায় দেড় হাজার লোককে কেন আসামি করা হলো?এতে প্রকৃত অপরাধীরা তো পার পেয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। যতক্ষণ দেশকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করা না যাবে ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চালাতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক অশোক সাহা বলেন, আজ যাদের হাতে রাষ্ট্র তাদের আশ্রয়ে এসব ঘটনা ঘটছে। রাজনীতির সাথে সাম্প্রদায়িকতা মিশলে এমন ঘটনা ঘটে। যারা রাষ্ট্র চালাবেন তাদের জাতীয় চার মূলনীতির প্রতি আস্থা থাকতে হবে। ক্ষমতায় থাকতে যাকে তাকে কোলে তুলে নিলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থাকবে না। আজ কম্পিটিশন চলে পশু শক্তিকে কে বেশি আদর করতে পারে। তাই ভবিষ্যতের কঠিন সংগ্রামে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু দুটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমরা এখন মুক্তির সংগ্রামে আছি। সারাদেশে একটি আন্দোলনই করা উচিত- সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা। প্রশাসন এত শক্তিশালী তারা কেন এসব সহিংসতা থামাতে পারছে না। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর যারা আপনাদের দলে ঢুকেছে তাদের চিহ্নিত করে বহিস্কার করুন। বঙ্গবন্ধু আপাদমস্তক একজন বাঙালি ছিলেন। আমরা কিন্তু বাঙালি হতে পারছি না। হাজার বছরের ঐতিহ্য যে নিয়ে যে বাংলাদেশ গড়েছিলাম সেখান থেকে আমরাও সরে যাচ্ছি। ডিজিটাল আইনে বিভ্রান্তিকর ওয়াজকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর্থিক উন্নতি হলেও জাতীয় উন্নতিতে আমরা পিছিয়ে গেছি। মুক্তির সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
নারী নেত্রী নূরজাহান খান বলেন, ঘাতক দালালরা যেন ছাত্রলীগে যুবলীগে বা অন্য সংগঠনে প্রবেশ করতে না পারে। ছাত্রলীগের ছেলেদেরই এটা বলতে হবে, দেখতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খেলাঘর সংগঠক অমল কান্তি নাথ বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমরা সবসময় মাঠে আছি। আমরা প্রতিবাদ করি সুফল যায় মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর ঘরে। কী দু:সাহস, ওই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হবেই হবে।
প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু এসব শব্দ ব্যবহারের জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রজন্মের একজন হিসেবে অনুভব করতে পারছি না মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আজ ক্ষমতায়। কারণ সেটা অনুভব করতে চাইলে জিহ্বায় ৫৭ ধারার পেরেক অনুভব করি। যখন মামুনুল হক বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভেঙে দেবে বলার পরও সারাদেশে ওয়াজ করে বেড়াচ্ছে। নারী বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ওয়াজ যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারা নেই। এই বাংলাদেশ তো আমরা চাইনি। আমাদের আবার লড়াই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দয়া করে নিজের দলের দিকে তাকান। সাম্প্রদায়িক লোকে দল ভরে গেছে। ৫৭ ধারার মামলার বাদি কারা? দলের তদন্ত করে দেখেন। না হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক ধারায় দেশ থাকবে না। বাংলাদেশ নামের সাম্প্রদায়িক দেশ হলে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন অর্থহীন হয়ে যাবে।
কবি সাংবাদিক ওমর কায়সার বলেন, যখন সারাদেশে ঘটা করে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী পালন করছে তখন সমাজটা একাত্তরের পরাজিত শক্তির দখলে। সরকার হয়ত প্রগতিশীল শক্তি পরিচালনা করছে। এজন্যই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে শাল্লার মত ঘটনা ঘটছে। আমাকে আমার মত করে পেতে হবে আমার সমাজকে। আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় সমাজ একাত্তরের পরাজিত শত্রুদের দখলে। তাদের হটাতে হবে। যা ঘটেছে শাল্লায় সইবে না আল্লায়।
চবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. বেণু কুমার দে বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। হাইব্রিডরা ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, সরকার ও প্রশাসনে ঢুকে বসে আছে। এক মিরজাফরের রক্ত থেকে লক্ষ মিরজাফর জন্ম নিচ্ছে। আমরাও বলতে চাই প্রতিহত করব। কেউ বসে থাকব না। যাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ আজ স্বাধীন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
উদীচী চট্টগ্রামের সংগঠক অধ্যাপক শীলা দাশগুপ্তা বলেন, আজ আমি শঙ্কিত ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে। কেননা এজন্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সত্য বললে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়। শাল্লার ঘটনার পর পুলিশ বলছে, হামলাকারীদের আমরা মানা করেছি। এটা কেমন কথা? সর্বত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন। ঘর না গোছালো সে আক্রমণ সবার উপর হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা পরিষদের সদস্য সচিব ডা.সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কী করে সংখ্যালঘুর উপর হামলা করে যখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা ক্ষমতায়?শাল্লায় যে ব্যক্তি স্ট্যাটাস দিল মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারলে হামলাকারীরা কেন গ্রেপ্তার হয় না?
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আহমেদ মুনির বলেন, যখন দেশজুড়ে জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষ পালন হচ্ছিল তখন শাল্লায় ন্যাকারজনক হামলা হয়। ইতিপূর্বে যত হামলা সবগুলোর একই প্যাটার্ন। কয়েকদিন আগে থেকে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। প্রতিহত করতে কোনো ব্যবস্থা প্রশাসন দিতে পারেনি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে যাবে। যে বাংলাদেশ সেদিন আমরা দেখলাম তা মুক্তিযুদ্ধের আগের বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যারা ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে তারা মুক্তভাবে ঘুরছে। তাহলে কী প্রগতিশীল মানুষকে দমনের জন্য আইন? এ হামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আমরা চাই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল বলেন, একাত্তরে যে সমাজ গঠিত হয়েছিল তা নেই। শাল্লায় গ্রামবাসীসহ আক্রমণ করেছে। তারমানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ধর্মান্ধ শক্তি বসে আছে। হেফাজতের শক্তি কোথায়? বারবার আক্রমণ হচ্ছে। সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ কিশোররা পাচ্ছে ওয়াজ মাহফিল। আগামী এক দশক পরে আমাদের সন্তানরাও এতে সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে। তাই সমাজ বদলের কাজ করতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউসুফ সোহেলের সঞ্চালনায় সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সহ- সভাপতি কবি আশীষ সেন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড চট্টগ্রামের আহ্বায়ক শাহেদ মুরাদ সাকু, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সারওয়ার আলম মনি, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রচার সম্পাদক আলীউর রহমান, তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক প্রীতম দাশ, আবৃতি শিল্পী ও সাংবাদিক অনুপম শীল, ছাত্র ইউনিয়ন চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি এ্যানি সেন, চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মাহমুদুল করিম, মহসীন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মায়মুন উদ্দিন মামুন।
সংহতি জানিয়ে উপস্থিত ছিলেন ন্যাপ নেতা মিঠুল দাশগুপ্ত, খেলাঘর সংগঠক মোরশেদুল আলম চৌধুরী, ছড়াকার গোফরান উদ্দিন টিটু, সাংস্কৃতিক সংগঠক সুনীল ধর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান, বোধন এর সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক রুবেল দাশ প্রিন্স, করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাজ্জাদ হোসেন জাফর, সালমা জাহান মিলি, চকবাজার থানা ছাত্রলীগ নেতা রাজীব কান্তি নাথ, যুবলীগ নেতা সাজ্জাদ হোসেন, শিবু প্রসাদ চৌধুরী ও আমিনুল ইসলাম আজাদ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের রায়হান উদ্দিন প্রমুখ।#