নারী যখন ছকে বাঁধা পুরুষ প্রতিনিধি» কবি কামরুল হাসান বাদল

নারী যখন ছকে বাঁধা পুরুষ প্রতিনিধি» কামরুল হাসান বাদল কবি সাংবাদিক লেখক সংগঠক

মন ভালো করা সংবাদে সকালটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো। গত কয়েকদিন ধরে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসটি বেরিয়ে এলো ফুসফুস হালকা করে। ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশকে মামলা না নেওয়ার পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমালোচিত বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং সেসঙ্গে ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এই বিচারককে রোববার সকাল থেকে আর আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান রোববার সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। সেখানে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘তার বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল হতে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট হতে অদ্য ৯টা ৩০ ঘটিকায় আইন মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।’
এর আগে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে বৃহস্পতিবার সব আসামির খালাসের রায় দিয়েছিলেন ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের এই বিচারক। সেসঙ্গে ধর্ষণ প্রমাণে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতার যুক্তি দিয়ে ওই সময়ের পর মামলা না নিতে পর্যবেক্ষণ দেন তিনি।
এমন পর্যবেক্ষণ নিয়ে সমালোচনার মধ্যেই শনিবার বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ‘আমি ওনার (বিচারক) রায়ের বিষয়বস্তু নিয়ে এখন কথা বলতে চাই না। কিন্তু ওনার (বিচারক) অবজারভেশনে ৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশ যেন কোনো ধর্ষণ মামলার এজাহার না নেয়, এই যে বক্তব্য উনি দিয়েছেন, এটি সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। বিচারক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন নিয়ে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেজন্য আগামীকাল (রোববার) প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি লিখছি।’
চার বছর পর ২২ জনের সাক্ষ্য নিয়ে গত বৃহস্পতিবার রায় দেন বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার। তাতে তিনি অভিযোগ ‘প্রমাণিত হয়নি’ সিদ্ধান্ত দিয়ে সব আসামিকে খালাস দেন।
বিচারের রায় নিয়ে কেউ হতাশ কেউ উৎফুল্ল হবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো এই আলোচিত মামলার রায় দিতে গিয়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক যা বলেছেন তা নিয়ে। মনে হলো বিচারক একজন নারী হলেও তার ওপর ভর করে থাকা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তিনি পাল্টাতে পারেননি। তিনি বলেন, অভিযোগকারী তরুণী ‘স্বেচ্ছায়’ রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে আসামির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, সেখানে ‘ধর্ষণ ঘটেনি’। তদন্ত কর্মকর্তা ‘প্রভাবিত হয়ে’ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা না হলে পুলিশকে ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার ‘নির্দেশ’ দিয়ে পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা পর মেডিকেল টেস্ট করা হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাতে মামলা প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে।’
রায় হচ্ছে কোনো একটি মামলায় দণ্ড বা সাজার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত। আর রায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ওই মামলা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অভিমত, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ; যা বিচারক প্রত্যাহার বা বাতিল করতে পারেন। নিম্ন আদালতের রায়ের পাশাপাশি পর্যবেক্ষণও উচ্চ আদালত বাতিল করতে পারে।
বিচারকের ওই পর্যবেক্ষণ দেশের সংবেদনশীল মানুষের মনে গভীর হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনাই শুধু নয়, সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মনে করেন দেশের অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। রায়ের পর বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীতে পদযাত্রা করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অর্ধশতাধিক নারী। সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের পাশাপাশি গৃহ, কর্মস্থল, গণপরিবহনে নারীর জন্যে নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা। ওই ধারায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলার যে সুযোগ রাখা হয়েছে আইনজীবীদের জন্য অর্থাৎ, আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’, ধর্ষণের শিকার নন, ওই ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন অধিকারকর্মীরা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা হল, চিকিৎসক মেডিক্যাল রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাননি মর্মে মতামত দিলেন, ভুক্তভোগীদের পরিধেয় কাপড়ে কোনো পুরুষের সিমেন্সের কনা পাওয়া যায় নাই। তারপরও তদন্ত চার্জশিট দাখিল করে আদালতের পাবলিক টাইম নষ্ট করেছেন। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেইপ কেসের বিচার ব্যাহত হয়েছে। তিনি অন্য কোনো পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে এই চার্জশিট দিয়ে মামলাটি বিচারের জন্য পাঠিয়েছেন। আজকের দিনসহ এই মামলায় ৯৪ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে।’
৭২ ঘণ্টার পর মেডিকেল পরীক্ষা করা হলে যে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না, সে কথা তুলে ধরে বিচারক পুলিশকে ওই সময়ের পরে কোনো মামলা না নিতে বলেছেন।
এই মামলার রায় নিয়ে আমার মতো অনেকের গভীর আগ্রহ ছিল কারণ আসামীরা বিশেষ করে প্রধান আাসামী একটি বিত্তবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হয় কিনা তা দেখার আগ্রহ ছিল অনেকের। রায় যে আহত করেছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না তবে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে বিচারকের পর্যবেক্ষণ। আমার নিজের আগ্রহ থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে একই ধরনের একটি ঘটনা নিয়ে নির্মিত মুম্বাইয়ের একটি ছবির কথা মনে থাকায়।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার সাথে ভারতীয় ছবি ‘পিংক’ এর কাহিনির সাযুজ্য আছে। ‘পিংক’ ছবিটির কাহিনিও অবিকল এই ঘটনার মতো। ছবিটি যারা আগে দেখেছেন এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পরপর তারা তাদের আলোচনা ও যুক্তিতে এই ছবির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। ধনী পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল তরুণীদের। মামলায় অসাধারণ যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তরুণীদের আইনজীবী তরুণীদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ (?) সত্ত্বেও প্রমাণ করেছিলেন, ভিকটিম তখন ধর্ষণে বাধা দিয়েছিল। তরুণীটি বলেছিল না। তাদের পক্ষের আইনজীবী বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘মেয়েটি না বলেছিল, ইয়োর অনার। না মানে না। আইনজীবী হিসেবে অমিতাভ অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন এই ছবিতে।
পিংক ছবিটিতে ওই মেয়েগুলোকে যেভাবে বেশ্যা, নষ্টা, চরিত্রহীনা হিসেবে আখ্যায়িত করার দৃশ্য অবলোকন করেছিলাম বাংলাদেশেও বাস্তবে তাই দেখতে পাচ্ছি। ভদ্রলোকের মুখোশ পরা সমাজের কীটরা এখন কতভাবেই না মেয়ে দুটিকে দোষী, কলগার্ল, পতিতা হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে।
এই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গিয়েছিল সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এই অপরাধের বিচার দাবি করে যেমন তেমনি করে এই মেয়ে দুটির চরিত্রহানি করেও। ফেসবুকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গড়পরতা মানুষের উপস্থিতি বেশি। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে অনেকে তাদের ক্ষোভ, বেদনা, আনন্দ প্রকাশ করেন খুব খোলাখুলিভাবে। এখানে সম্পাদনা করার কেউ নেই বলে অনেক ক্ষেত্রে অশালীন, অশোভন, অভদ্র বক্তব্যও প্রকাশ পেয়ে যায় সহজেই। বাক্য গঠন কিংবা বানান শুদ্ধ হলো কি হলো না এ নিয়ে চিন্তিত নন এমন ব্যক্তিও দিনে তিন/চারটি স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন। তবে কোনো কিছুই ফেলে দেওয়ার মতো নয়, এর মাধ্যমে সমাজের সাধারণ কিছু মানুষের মতামত জানার সুযোগ হয়। সুযোগ হয় কোনো ঘটনার সম্পাদনাহীন প্রতিক্রিয়া জানার।
দু’ছাত্রী লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা নিয়েও তোলপাড় হয়েছে ফেসবুকে। এর মধ্য থেকে নুরুল আবসার নামের এক ব্যক্তির স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দিচ্ছি পাঠকদের উদ্দেশে বানান ও বাক্যগঠন তাঁর মতো রেখে, ‘আমি জানি অনেকে আমার সাথে একমত হবে না। গালিও দিবে। আনফ্রেন্ডও করিবে। হ্যাঁ আমি বনানীর ধর্ষণ ঘটনা নিয়েই বলছি। ধর্ষকদের সাজা চাই আমিও তবে সেটা ধর্ষণের জন্য নয়। তাহারা এমন খারাপ কাজের ভিডিও করেছে তাহার জন্য। তাহারা ভয় ভীতি দেখাইয়াছে কিনা জানি না। তবে মেয়ে দুটি যে জেনে শুনেই গিয়াছে তাহাই সত্যি। এদের জীবনে এমন কিছু এই প্রথম নয়। তাহাদের মা বাবাও মেয়েদের ইনকামে ছেড়ে দিয়াছে। এরা কলগার্ল ছাড়া কিছুই নয়। তাহাদের অনিচ্ছায় কিছু হলে তাহারা সকালে উঠে রিসিপসনে অভিযোগ করিত। পুলিশ স্টেশনে যাইত। ঘরে গিয়া মা বাবাকে জানাইত। দেড় মাস পরে কেন অভিযোগ? ওদের ধর্ষকরা ব্লাকমেইল করিয়াছে তেমন কিছুই জোর দিয়া বলেনি। দেনা পাওনার হিসাব গড়বার হইয়াছে বলেই এই অভিযোগ। এমন মেয়েদের কারণে সমাজ কলুষিত হচ্ছে। এই নরপশুদের সাথে সাথে এইসব মেয়েদের সমাজে সাজা দেওয়া উচিৎ। এদের মায়ের জাত বলিলে মাকেই অপমান করা হবে।” এই ব্যক্তি তার স্ট্যাটাসে বিভিন্নজনের মন্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে এই মেয়েদের পতিতা, কলগার্ল বানিয়ে ছেড়েছেন। এবং এক জায়গায় লিখেছেন তাঁর এই ধরনের মেয়ে থাকলে তিনি অনার কিলিং করতেন।
কী আশ্চর্য! চার বছর আগে খুব সাধারণ এক পুরুষের মতামত অবিকল প্রকাশ পেল এক নারী বিচারকের কণ্ঠে। অর্থাৎ বিচারক নিজে নারী হলেও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার বাইরে স্বাধীনভাবে ভাবতে পারেননি তিনি। একটি সভ্য দেশে কোনো ব্যক্তির পক্ষে ভিকটিম সম্পর্কে এমন অশালীন মন্তব্য করা সম্ভব বলে মনে হয় না। এই একজন নুরুল আবসারকে দিয়ে আমাদের সমাজের প্রকৃত চেহারাটি আমরা দেখতে পাব। আমরা অনুধাবন করতে পারবো এখনো সমাজে একজন নারীকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হয়। নারীর প্রকৃত অবস্থানটি সমাজে কেমন। হেফাজতের আমীর শফি সাহেবের একটি মন্তব্যে দেশে তোলপাড় হয়েছিল। আমারতো মনে হয় তিনি খুব মন্দ বলেননি। বরং তাঁর কথায় এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষের প্রকৃত চরিত্রটিই বেরিয়ে এসেছিল।
এই সমাজে একটি নারী ধর্ষিত হয় একবার। আর এ ঘটনা জানাজানির পর সে নারীকে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হতে হয় পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে। যাঁরা আইন পেশায় আছেন তাঁরা এবং যাঁদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে তাঁরা খুব ভালোভাবেই জানেন ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে, এই মামলা চালাতে গিয়ে একই নারীকে কতভাবেই না আরও ধর্ষিত হতে হয়। এই সমাজ এখনো নুরুল আবসারদের চোখ দিয়ে নারীদের দেখে। এই সমাজ এখনো নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখে। পুঁজিবাদী বিশ্বে ভোগবাদকে উসকে দেওয়া হয়। বিনোদন ও মনোরঞ্জনের জন্য হাজারো উপাদান তৈরি করা হয়।
আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার সে সময় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, তাঁর সুপুত্রের প্রতিদিনের হাত খরচ দুলাখ টাকা। তথ্যটি বিস্ময়কর। একজন তরুণ এই ঢাকা শহরে প্রতিদিন দু লাখ টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ করবে? মদ, মেয়ে মানুষ, হেরোইন, ইয়াবা ছাড়াতো আর কোনো রাস্তা নেই তার। ফূর্তি-মাস্তি মানেই তো মদ আর মেয়ে মানুষ। একটি ছেলের প্রতিদিন দুলাখ টাকা হাত খরচ, এই খরচতো বিল গেটসের ছেলেও পায় না। এর তুলনা চলতে পারে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারে, যেখানে ব্যভিচারই হচ্ছে তাদের সংস্কৃতি।
ধর্ষণ যে শুধু বাংলাদেশ বা এই উপমহাদেশে হচ্ছে তা নয়। পশ্চিমা বিশ্ব, যেখানে নরনারীর মুক্ত মেলামেশার সুযোগ আছে, সেখানেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তবে বাংলাদেশের সাথে তার ব্যতিক্রম হচ্ছে-ওখানে ধর্ষিতা বিচার পায়। ধর্ষক সমাজের কে, তার সামাজিক কী অবস্থান, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় কী এসব ওদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমলে নেয় না। ওখানে একজন নারী জানে রাষ্ট্র তাকে কীভাবে সুরক্ষা দিয়েছে। আর বাংলাদেশে পুলিশের প্রথম কাজ হচ্ছে এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে প্রথমেই অভিযোগকারীনিকে হতাশ ও নিরুৎসাহিত করা। আর এক্ষেত্রে অভিযুক্ত যদি সমাজের হোমরা চোমড়া শ্রেণির হয় তখন আপনা থেকেই তার লেজ নড়তে থাকে। পুলিশই উদ্যোমী ভূমিকা পালন করে কীভাবে প্রভাবশালী অভিযুক্তকে বাঁচানো যায়।
পশ্চিমা বিশ্বে কী অবস্থা তা নিয়ে সেসময় লিখেছিলেন কানাডা প্রবাসী ও ‘নতুন দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সেরীন ফেরদৌস, ‘জানি, পশ্চিমের এই শহরটাতে তুলনামূলকভাবে আমার দুই কন্যা সন্তান নিরাপদ। কোনো অপরাধের শিকার হলেও, প্রচলিত আইনে ন্যায্য বিচার তারা পাবে। পাবেই, কোনো মন্ত্রী-আমলা-টাকার কুমিরও সেই শাস্তি থেকে ছাড় পাবে না। একচুলও নয়। আর এইটুকু নিরাপত্তাবোধ যে কী বিশাল শান্তি। আমার মেয়ে যতই বুক চিতিয়ে হাঁটুক না কেন, হাঁটুর ওপরে স্কার্ট পরে ঘোরাঘুরি করুক না কেন, ওর মাথাতেই নেই এতে ওর নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হতে পারে। ও পরিষ্কার জানে, একটি ছেলে তিন সেকেন্ডের বেশি ওর শরীরের কোনো অংশে মনোযোগ দিলে ওর কর্তব্য কী? ও জানে সেলফোনে তিনটি নম্বর ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে ওকেই বিশ্বাস করবে সবার আগে। শুধু মেয়েই নয়, সম্ভাব্য ধর্ষকও এ তথ্য জানে। স্কুল ওকে প্রতি পলে পলে শিখিয়েছে সব। ছেলে শিশুদের যথাযোগ্য মগজ ধোলাইয়ের কাজও সারা হচ্ছে স্কুলে, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে।”… ছেলেরা জেনে যায় ধর্ষণতো দূরের কথা, মেয়েদের সামান্য অ্যাবিউজ করে কেউ ছাড় পাবে না আইন ও প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে। সামাজিক অবমাননা থেকে।”
আর আমাদের সমাজে একটি ছেলে শিশু বেড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি মেয়েকে, নারীকে অপমানিত হতে দেখে দেখে। সামান্য মানুষেরও মর্যাদা না পাওয়া নারীদের তাই এখানে পুরুষের ইচ্ছার দাস হিসেবে দেখা হয়। তার গায়ে হাত দেওয়া যায়, তার দিকে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া যায়। এবং সুযোগ পেলে তার শরীর নিয়ে মেতে ওঠা যায়। কারণ এখানে তো ঘরের বাইরে পা রাখা নারীদের নষ্টা বলে দেখা হয়। আর বন্ধুদের বিশ্বাস করে তার অনুরোধে কোনো পার্টিতে গেলে তাকে বেশ্যা বা পতিতা বানিয়ে দেওয়া হয়।
এদেশের পুরুষরা বিশ্বাসই করতে চায় না, নারীর শরীরের মালিক নারীই। তার অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া তার শরীর স্পর্শ করা মানে অনধিকার চর্চা করা, নারীকে অপমান করা। অসম্মতিতে নিজের স্ত্রীর সাথে সহবাসও ধর্ষণ বলে বিবেচিত। একজন নারীর না বলা মানে, যে কোনো অর্থে না। না বলা মানে আমার শরীর থেকে তোমার কুৎসিত হাত গুটিয়ে নাও পুরুষ। হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতার একটি অংশও বেশ উল্লেখযোগ্য মনে হয় এই প্রতিবাদে-
‘রক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে-যাওয়া
আমার বছরগুলো
আজকে যখন হাতের মুঠোয়
কণ্ঠনালীর খুন পিয়াসী ছুরি,
কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে
কেউটে সাপের ঝাঁপি !
আমার হাতেই নিলাম আমার
নির্ভরতার চাবি;
তুমি আমার আকাশ থেকে
সরাও তোমার ছায়া…’.