বীর চট্টলার ‘হৃদয়খানি’ লালদীঘির মাঠ-কামরুল হাসান বাদল

বীর চট্টলার ‘হৃদয়খানি’ লালদীঘির মাঠ
কামরুল হাসান বাদল
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশের যুবসমাজকে সংগঠিত করতে ১৯০৯ সালে নগরীর লালদীঘি মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতা বা বলী খেলার আয়োজন করেছিলেন বক্সিরহাট এলাকার আব্দুল জব্বার সওদাগর, যা জব্বারের বলীখেলা নামে পরিচিতি লাভ করে । ১২ বৈশাখ লালদীঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় জব্বারের বলীখেলা এবং এই বলীখেলাকে
কেন্দ্র করে এর আশেপাশের এলাকায় বসে বৈশাখীমেলা। কালের পরিক্রমায় এই মেলা চট্টগ্রামবাসীর ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই মেলায় বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসে। কেউ আসে পণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে কেউ আসে কেনার উদ্দেশ্যে। বছর ধরে তাই অপেক্ষা চলে এই মেলার জন্য।
একটি দীঘি এবং তার পাশের মাঠটিকে কেন লালদীঘি ও লালদীঘির মাঠ বলা হয় তা নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতূহল আছে। নামকরণটি হয়েছিল লোকমুখে। কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নয়। ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামের শাসনভার লাভ করে। সেই সময় জমি সংক্রান্ত তহসিল অফিসটিতে (বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ অফিস) লাল রঙ দেয়া হয়েছিল। এটিকে লোকজন তাই ‘লালকুঠি’ বলে চিনত। (সে ভবনটি এখন নেই, কয়েকবছর আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে)। এই লাল কুঠির পুর্ব দিকে ছিল জেলখানা। এটির দেওয়ালও লাল রং করা হয়েছিল তাই এটি ‘লাল ঘর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। (চট্টগ্রামের অনেক মানুষ
এখনও জেলখানাকে লালঘর বলে)। অনেকেই মনে করেন এ কারনেই ভবনগুলোর নাম লাল ঘর এবং লাল কুঠি। লাল ঘর এবং লাল কুঠির পাশে একটা ছোট পুকুর ছিলো। চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসনের সূচনালগ্নে পুকুরটিকে বড় করে দীঘিতে পরিণত করা হয়। পাশেই দুটো লাল রঙের ভবনের মতো এই দীঘিটাও লালদীঘি নামে পরিচিতি পায়।
মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরের পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পশ্চিমে পরীর পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পুরো জায়গাটা সেকালে মিউনিসিপ্যাল ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৭ সালে এই ময়দানে মহারানী ভিক্টোরিয়ার মূর্তি স্থাপন করা হয়। চল্লিশের দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে এই মূর্তি অপসারন করা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষে লালদীঘি হতে কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত রাস্তাটি হওয়ার পর মিউনিসিপ্যাল ময়দান বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্বদিক সাধারণ জনগনের খেলার মাঠে রূপান্তরিত হয়। মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তখন সে মাঠ মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে পরিণত হয়। তবে মাঠটি লালদীঘির মাঠ নামেই পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯০৯ সালে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এই দেশের তরুণসমাজকে উদ্ভুদ্ধ করতে আবদুল জব্বার সওদাগর এই মাঠে বলীখেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এই মাঠকে ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতেও দেশের আন্দোলন-সংগ্রামে এই মাঠ ব্যবহৃত হয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন এবং তারপর স্বাধীন দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এই মাঠের নাম জড়িয়ে আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের প্রায় সকল জাতীয় নেতা এই মাঠে বক্তৃতা করেছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ সভা এই মাঠেই সম্পন্ন হয়েছে।
সাতচল্লিশে দেশভাগের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের প্রকৃত স্বৈরাচারী চেহারা নগ্নভাবে প্রকাশ
হতে থাকে। কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণের পর এদেশের মানুষ প্রতিবাদ ও ক্রোধে ফুঁসতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দাবি দিনদিন জোরালো হতে থাকে। এর ফলে নতুন করে শুরু হয় ছাত্র বিক্ষোভ, ধর্মঘট, হরতাল। গঠিত হয় সর্বদলীয় একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা ঠিক করেন তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবেন। আজকের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সেসময় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। সেখানে ২১শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভকারীরা ১৪৪ ধারা ভাঙতে গেলে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেফতার করে, পরে কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষেপ করে। দুপুরের পর বিক্ষোভরত ছাত্রদের একটি দল গণপরিষদ ভবনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই মাঠে চট্টগ্রাম দোকান কর্মচারী সমিতির সম্মেলন চলছিল। সম্মেলনে আমন্ত্রিত বক্তা ছিলেন চৌধুরী হারুন। তিনি তাঁর বক্তব্যে সেদিন ঢাকায় ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির সংবাদ জানান ও জনতাকে এর প্রতিবাদে মিছিল করতে আহবান জানালে উপস্থিত জনতা সাথে সাথে মিছিলে নেমে পড়ে। এই মাঠেই একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুন। ঢাকায় ছাত্রদের প্রতিবাদ সমাবেশে গুলি করে হত্যার খবর পাওয়ার পরপরই রাউজান উপজেলার গহিরায় নানার বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় কবিতাটি লিখেছিলেন সে সময়ের তরুণ রাজনীতিক, সংস্কৃতকর্মী ও কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরী। এভাবেই লালদীঘির মাঠের নাম আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়।
এই মাঠ পরবর্তীতে বাঙালির দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসেও স্থান করে নেয়। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয় দফা ছিল বাঙালির ‘ম্যাগনা কার্টা’। যা বাঙালির স্বাধীনতা প্রাপ্তির পথ সুগম করেছিল। সে ছয় দফার প্রথম জনসভাটিও হয়েছিল এই লালদীঘি মাঠে।
১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানের লাহোরে পৌঁছান এবং তার পর দিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা দাবি পেশ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এই সম্মেলন বর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকায় ফিরলে ছয় দফা উত্থাপন নিয়ে দলের একাংশ বঙ্গবন্ধুর তীব্র বিরোধিতা করে। বঙ্গবন্ধু জানতেন লাহোরে বিরোধীদলীয় সম্মেলনে তিনি ছয় দফা উত্থাপন করবেন জানালে দলের বিরোধিতার কারণে তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে তাই অত্যন্ত কৌশলে তিনি ছয় দফা দাবি লাহোরে বিরোধীদলের সমেলনে উত্থাপন করেছিলেন। দলের একাংশের বিরোধিতা ও অসহযোগিতা এবং পাকিস্তানিদের তীব্র বাধার মুখে ছয় দফা নিয়ে ঢাকায় প্রকাশ্য জনসভা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। সেসময় বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ালেন এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই লাল দীঘি ময়দানে বিশাল
জনসভায় বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচির প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন, যে কর্মসূচির পথ ধরে মাত্র পাঁচ বছরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সেদিনের সভায় বক্তব্য দেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, এম এ আজিজ, আবদুল্লাহ আল হারুন। সভা শেষে সভাপতি জহুর আহমদ চৌধুরী সভার লিখিত প্রস্তাব পাঠ করেন। এই প্রস্তাবটি আগেই লিখে রেখেছিলেন শহর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ইদরিস আলম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছয়দফা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি এই কর্মসূচির প্রথম সভার স্থান হিসেবে লালদীঘির নাম ইতিহাসে অঙ্কিত হয়ে গেছে।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আয়োজিত সমাবেশে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি চালালে ২৪ জন নিহত ও আহত হন প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। ঘটনাটি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও লালদীঘির পাড়ে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো পুরাতত্ত্বের দিক থেকে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। দিঘির উত্তর পাড়ে একটি প্রাচীন মঠ এখনো বিদ্যমান। ঘোষ মঠ নামে পরিচিত এই স্থাপনাটি ১৯৩৯ সালে স্থানীয় জমিদার রায় বাহাদুর রাজকুমার ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন স্যার হেনরি রিকেটস। তাঁর স্মৃতিতে লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে একটি পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়। এটি রিকেট ঘাট নামে পরিচিত ছিল। তবে এর অস্তিত্ব এখন নেই। দক্ষিণ পাড়ে ব্রিটিশ আমলের ম্যাজিস্ট্রেট বকল্যান্ড মিলনায়তন ও ঘাট নির্মিত হয়। ঘাটটি অবশিষ্ট নেই। মিলনায়তনটি ১৯০৩ সালে গ্রন্থাগারে রূপান্তর হয়। সিটি করপোরেশন সে জীর্ণ ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন করে গ্রন্থাগার করেছে। ১৯৭৪ সালে লালদীঘির পশ্চিম পাড়ে নির্মাণ করা হয় একটি মসজিদ।
ঢাকার সোহরাওয়ারদী ময়দানের মতো দেশের মুক্তিসংগ্রামে ভূমিকা রাখা ঐতিহাসিক ছয়দফা ও জাতির পিতার স্মৃতিধন্য লালদীঘির পাড়কে সংরক্ষণ করে একটি স্মারক বানানোর দাবি ছিল মানুষের। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সরকার সে উদ্যোগ নিয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে বঙ্গবন্ধূকণ্যা শেখ হাসিনা আরেকটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন। আগামী ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে নতুন করে সাজানো ময়দানের উদ্বোধন করবেন তিনি।
জানা গেছে, জাতির পিতা যে স্থান থেকে ছয়দফা ঘোষণা করেছিলেন সেখানে তৈরি হয়েছে মুক্তমঞ্চ। টেরাকোটার কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। নতুন প্রজন্মের কাছে এই মাঠের ইতিহাস তুলে ধরতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। বঙ্গবন্ধু মাঠের যে স্থানে দাঁড়িয়ে ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন সেখানে তৈরি হয়েছে মুক্তমঞ্চ। মাঠের চারপাশে এখন শোভা পাচ্ছে নান্দনিক শিল্পকর্ম। মাঠের ১ হাজার ২৫০ বর্গফুট দেওয়ালের দুই পাশে লেখা হয়েছে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা। মাঝখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনরত আপামর বাঙালির ঐতিহাসিক ৬টি ছবি। উত্তরপাশে তৈরি করা হয়েছে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৫ ফুট প্রস্থের মুক্তমঞ্চ, ৩৪৮ মিটার লম্বা ওয়াকওয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ১৮টি টেরাকোটার মাধ্যমে। এসব শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বাঙালির শতবছরের সংগ্রামের ইতিহাস, বিজয়ের কাহিনি। বালুময় মাঠটি এখন ঢেকে গেছে সবুজ ঘাসে। মাঠকে সুরক্ষিত করতে দুই পাশে লোহার নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। দুটি সাধারণ ও একটি ভিআইপি ফটক, বসার জন্য ৩৯টি বেঞ্চ, শিশুদের জন্য একটি মিনিপার্ক এবং মাঠকে দৃষ্টিনন্দন করতে রোপণ করা হয়েছে বাদাম ও দেবদারু গাছ। সোলার প্যানেল দিয়ে করা হয়েছে লাইটিং।
বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামবাসীর ‘হৃদয়খানি’ লালদীঘির মাঠ। এই মাঠ এখন পরবর্তী প্রজন্মকে পাঠ দেবে ইতিহাসের, দীক্ষা দেবে দেশপ্রেমের।