দেশভাগের ক্ষত এবং সাম্প্রদায়িকতার কুৎসিত রূপ-কামরুল হাসান বাদল,সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও কবি

বুদ্ধদেব বসু তার ‘আত্মজৈবনিক’ গ্রন্থের ‘আমার ছেলেবেলা’ অংশে লিখেছেন, “সন্ধ্যেবেলার আবছা আলোয় উঠোনজুড়ে আলপনা দিচ্ছেন আমাদের বাড়ির বৃদ্ধা বিধবা, আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছি উঠোনের জ্যোছনা ফুটলো, চালের গুঁড়োর ফ্যাকাশে লাইনগুলোকে চকচকে শাদা দেখাচ্ছে এখন- বড্ড ঘুম পাচ্ছে আমার, দিদিমা আমাকে ডাল আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। আমার মাথা ঢুলে পড়ছে ঘুমে, লণ্ঠন থেকে দশটা আলোর তীর আমার অর্ধেক বোঝা চোখের মধ্যে বিঁধছে- আমার নাক টের পাচ্ছে মসুরডালে তেজপাতার সুগন্ধ, সেদ্ধ ডিমের সরল কোমল মসৃণতা আমার জিহ্বাকে আদর করছে। এ স্মৃতিগুলির সময় আলাদা, ঘটনাস্থলও নিশ্চয়ই এক নয়- কোন বছরে কোন শহরে এ-সব সুখ আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে আমার চেতনার প্রথমতম মিলনের চিহ্ন এগুলোই।”
অশোক মিত্র তার ‘আপিলা-চাপিলা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “কলকাতা নোয়াখালী দাঙ্গা জের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের পাঠচর্চা বিঘ্নিত। এরইমধ্যে উত্তর থেকে নির্দিষ্ট অমোঘ বিধানের মতো, সিদ্ধান্ত অনুশাসন। কংগ্রেসের কর্তাব্যক্তিরা আর অপেক্ষা করতে রাজি নন, কিছুদিন আগেও বিদেশী শাসক-প্রস্তাবিত ঈষৎ নিখিল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে খসড়া দাখিল করা হয়েছিল তা পেরিয়ে এবার তাদের অসহিঞ্ষু উৎসাহের পরিক্রমা; মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি পুরোপুরি মেনে নিতেও তারা সম্মত। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমাদের বাঙালির সত্তা চরম সংকটের সম্মুখীন; দেশ ভাগ হয়ে গেলে আমাদের কী অবস্থা দাঁড়াবে, ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শ থেকে, বেপথুমান কোথায় গিয়ে অনিশ্চিত অবস্থান করবো?”
তারপরে লিখেছেন, “কিন্তু দেশভাগ ও বঙ্গভাগের এই উৎসাহতরঙ্গ রোধিবে কে? ‘৪৭ সালের মধ্য-আগস্ট, রাতারাতি পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। আমরা অবশ্য মনস্থির করেছিলাম, যে-কংগ্রেস দল আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যে-দল অথচ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেবে তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হওয়াই় ভালো; আমরা পাকিস্তানের বিশ্বস্ত নাগরিক হবো সব সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলেমিশে নতুন দেশ গঠন করবো। এমনকি লিগ নেতাদের অনেকেই অন্তত প্রথম লগ্নে এই ধরনের সংকল্পেরই এই প্রতিধ্বনি করেছিলেন।”
প্রণব বর্ধন তার ‘স্মৃতিকণ্ডূয়ন’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমার বাবা-মা পূর্ববঙ্গের লোক (আমি ওঁদের সঙ্গে সর্বদা ঢাকার বাংলাতেই কথা বলতাম), কিন্তু ওঁরা কলকাতায় বসবাস শুরু করেছেন দেশভাগের অনেক আগে থেকেই। দেশভাগের অব্যাহিত আগে থেকে শুরু করে পূর্ববঙ্গীয় আত্মীয়-স্বজনরা স্রোতের মতো এসে আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত স্বল্পপরিসর ভাড়াটে বাড়ি প্লাবিত করে ফেলে। আমার শৈশবের স্মৃতিতে বাড়ির সব ঘর লোকে গিজগিজ করছে, বাড়িটাতে একটা বাজারের মতো অবস্থা, আমার বাবা-মা সর্বদা ব্যতিব্যস্ত। এই অবস্থা থেকে মাঝে মাঝে পরিত্রাণের জন্য বাবা আমাদের কয়েকজনকে শান্তিনিকেতনে আমার মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। নিঃসন্তান আমার মামা আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকা সত্ত্বেও, সাদরে আমাদের অভ্যর্থনা করতেন।”
বুঝতে না পারার কথা নয় যে, এ-তিনজনের দুইজন তাদের স্মৃতিকথায় শৈশবে ফেলে যাওয়া দিনগুলোর কথা বলেছেন। একজন তার ছোটবেলার স্মৃতিতে ইতিহাসের এক নির্মম চিত্রকে তুলে ধরেছেন।
এবার নিজের কথা বলি। আমার জন্ম রংপুরে। শৈশবও কেটেছে সেখানে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি পীরগাছা জে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাবা চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৭৪ সালে আমরা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে ফিরে আসি। রংপুর যেতে পাসপোর্ট-ভিসার কোনো ঝামেলা নেই, কারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। নিরাপত্তা নিয়েও কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু তারপরও এ দীর্ঘসময়ে আমি মাত্র দুইবার যেতে পেরেছি রংপুর। অথচ এমন কোনো দিন নেই যেদিন কোনো না কোনো সময়ে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়েনি। ছোটবেলার বন্ধু, ফেলে আসা প্রিয় মুখগুলোর কথা মনে পড়ে না। ফেলে আসা খেলার মাঠ, প্রিয় প্রাঙ্গণ, আর ট্রেনের হুইসেলের শব্দ।
তাই আমি বুঝতে পারি একদিন যাদের প্রিয় ভিটেমাটি, বাপদাদার ঠিকানা ছেড়ে অজানা, অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে হয়েছিল, তাদের বেদনা। আমি বুঝতে পারি প্রতিদিন স্মৃতিকাতর করা সে ভিটেমাটি দেখার সাধ হলেও সুযোগ সবার হয় না। রাজনীতি একটি শক্ত দেয়াল তৈরি করে দিয়েছে যা ডিঙিয়ে আসা-যাওয়া প্রচণ্ড ঝামেলার।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ভারতবর্ষ জুড়ে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। হিন্দুদের জন্য ভারত আর মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান- এমন ধারণা ও সিদ্ধান্ত কয়েক কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছিল। দাঙ্গা ও হানাহানিতে নিহত হতে হয়েছিল হাজার হাজার অসহায় মানুষকে। নারী ও শিশুকে। যে কোনো যুদ্ধ ও দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরা। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়েও প্রচুর নারীকে নির্যাতিত হতে হয়েছিল প্রতিপক্ষের হাতে। শত শত বছর একই সাথে বসবাস করা মানুষগুলো রাতারাতি কীভাবে হিংস্র দানবে রূপান্তরিত হয়েছিল তা দেখে শুধু শান্তিপ্রিয় ভারতবাসী নয় সদ্য ভারতত্যাগী ব্রিটিশরাও হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
ভারত ভাগে সবচেয়ে বেশি দাম দিতে হয়েছে পাঞ্জাব, বাংলাকে। কারণ এ দুইটি প্রদেশও বিভক্ত অর্থাৎ ভাগ হয়ে পড়েছিল দুই দেশে। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে পাড়ি জমাতে হয়েছে লাখ লাখ মানুষকে। এদের অনেকেই হয়ে পড়েছিলেন ঠিকানাহীন। এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়েছিল। লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা পাল্টে গিয়েছিল। অনেকে রাতারাতি রাজা থেকে ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবতা। সে লাঞ্ছনা, অত্যাচার আর ভয়াবহ নির্যাতনের ক্ষত এখনো শুকায়নি পাঞ্জাব ও বাংলার জনগণের মন থেকে। সেই অসভ্যতা, বন্যতা চিরস্থায়ী ক্ষত রেখে গেছে এ দুই জনপদে।
এ নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিলেন উপমহাদেশের কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা। এসব ঘটনা নিয়ে রচিত হয় অনেক কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। সে ভয়াবহ দাঙ্গার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তিতুল্য লেখক কৃষণ চন্দর, খাজা আহমেদ আব্বাস, সাদত হাসান মান্টো, রাজেন্দ্র সিং বেদী, আহমদ নাদিম কাসমী, ইসমত চুগতাই, রায়নাল কুদরউল্লাহ প্রমুখ। বাংলা ভাষার পাঠকরা এই লেখকদের অধিকাংশের লেখার সঙ্গে পরিচিত।
এ নির্মম, নিষ্ঠুর পরিস্থিতি নিয়ে ভারতে কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে সম্প্রতি নির্মিত ‘পার্টিশান ১৯৪৭’ একটি উল্লেখযোগ্য ছবি। ১৯৪৯ সালে মুম্বাইয়ে পরিচালক এম এন আনন্দ তৈরি করেন ‘লাহোর’ ছবিটি। এরপর বিজয় রায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘ক্যায়া দিল্লি ক্যায়া লাহোর’। এরপর সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’ (১৯৫৩) শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের ‘রিফিউজি’ (১৯৫৪)। ঋত্বিক ঘটকই এই বিষয়টাকে তার তিন-তিনটি ছবিতে অত্যন্ত শিল্পসম্মত ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। ছবি তিনটি, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’। ঋত্বিকের পরে বেশ কিছু ছবি তৈরি হয়েছে দেশভাগকে কেন্দ্র করে। ‘বিপাশা’, ‘আলো আমার আলো’ ইত্যাদি ছবিতে দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে। রাজেন তরফদার তার ‘পালঙ্ক’ ছবিতে দেশভাগের প্রসঙ্গটিকে চমৎকারভাবে নিয়ে আসেন। তবে ইদানিংকালে নতুন করে দেশভাগকে কেন্দ্র করে ছবি তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাঁটাতার’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘তাহাদের কথা’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজকাহিনি’ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’, ‘বিজয়া’ দেশভাগের ছবি।
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মাটি’ ছবিটি আমার ভালো লেগেছে। নবীন চলচ্চিত্রকার সব্যসাচী দে ‘রেড রিবন’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছেন যার কেন্দ্রমূলে আছে সীমান্ত এবং তার কাঁটাতার। সৌমিত্র দস্তিদারের মত প্রামাণ্য চিত্রনির্মাতা দেশভাগ নিয়ে ছবি করেছেন। এগুলো দেখার সুযোগ ঘটেনি।
দেশভাগের নির্মমতা নিয়ে খাজা আহামদ আব্বাসের ‘ছুরি’ গল্পটি বিখ্যাত। গল্পটির শেষাংশটুকু পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। গল্পের নায়ক হরিদাস। ছিলেন লায়ালপুর কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী। দাঙ্গার বলি হয় তার পুরো পরিবার। সেখানে তার ১৭ বছর বয়েসি কন্যা জানকীও ছিল।
লেখক লিখেছেন, “কোথাও দাঙ্গা বা হত্যাযজ্ঞের কথা উঠলে তাঁর চোখ দুটোতে যেন আগুন জ্বলে। তার চোখে মুখে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। একসময় তার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে। তখন তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন, প্রতিশোধ! প্রতিশোধ!! প্রতিশোধ!!!”
সে সময় প্রতিপক্ষের নারীদের ধরে এনে ধর্ষণ করা হতো। তারপর তাদের পতিতালয়ে বিক্রি করে দেওয়া হতো। প্রতিপক্ষের নারীর ওপর প্রতিশোধ নিতে হরিদাস একদিন পতিতালয়ে যায় এবং দুইশ রুপির বিনিময়ে লাভ করে একটি মেয়েকে।
তারপর-
হরিদাস ভিতরে প্রবেশ করলেন। সাবধানে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সে দেওয়ালের দিকে মুখ করে খাটের কোনায় বসে আছে। হরিদাসকে দেখতে পেয়ে খাট থেকে উঠে সে হরিদাসের জুতার ফিতা খুলতে আরম্ভ করল। তাকে হয়ত ওটাই করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।
“ওটা রাখ’ তিনি কর্কশ গলায় বলে উঠলেন। তিনি মনে মনে খুশি হলেন এই ভেবে যে, তার প্রতিপক্ষের একটা মেয়ে তার পায়ে হাত রেখেছে।”
পোশাক খুলে ফেল তিনি আদেশ করলেন। মেয়েটি কম্পিত হাতে তার শাড়ি খুলে ফেলল। তার শরীরে এখন শুধুমাত্র পেটিকোট ও ব্লাউজ অবশিষ্ট আছে।
ওগুলোও। লজ্জায় মেয়েটি দেওয়ালের দিকে মুখ ফেরাল। পেটিকোটটা মাটিতে পড়ে গেল। হরিদাস হাত রাখলেন। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দেখতে চাই। বুঝতে পেরেছ কি? এটা বিনা অর্থে নয়। আমি পুরো দু’শ রুপি এর জন্য দিয়েছি।
মেয়েটি তার মধ্যবয়সী খরিদ্দারের মন গলানোর জন্য অব্যক্ত ভাষায় চারদিকে ঘুরে আকুতি জানাল যাতে লোকটি তাকে দয়া করে সম্পূর্ণ উলঙ্গ না করে।
‘তাড়াতাড়ি কর’ হরিদাস অসভ্যের মতো চিৎকার করে উঠলেন।’ আমার সময় নেই।’
তার হাতটা পকেটে রাখা চাকুর ধারাল অংশে। মেয়েটি ধীরে ধীরে বিদ্যুতের সুইচের কাছে যাচ্ছে দেখে তিনি তার পথরোধ করে বললেন, না আমি অন্ধকার চাই না। জানকীকে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় পাবলিক রোডের ওপর কি অসম্মান করা হয়নি? তাঁর মনে পড়ল।
মেয়েটি তার ব্লাউজ খুলে ফেলল। শুধুমাত্র ব্রেসিয়ারটা তার যৌবনের চিহ্নটিকে ঢেকে রেখেছে।
‘ওটাও।’ হরিদাস ব্রেসিয়ারের দিকে নির্দেশ করে বললেন। চাকুটাতে হাত রেখে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে ফেললেন। আর একবার মেয়েটি লোকটার দিকে তাকিয়ে তার প্রতি দয়া দেখানোর জন্য মিনতি জানায়। ঠিক এইভাবেই জানকী হৃদয়হীন পশুগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু তারা জানকীকে দয়া করেনি। তাকেও না।
মেয়েটি তার হাত দুখানা দিয়ে মুখটা ঢেকে ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। কয়েক বিন্দু চোখের জল তার ব্রেসিয়ারের ওপর পড়ল। হরিদাসের ডান হাতে ধারালো ছুরি ঝলসে উঠল। ছুরির মাথায় বিষ মাখানো। এই মুহূর্তটির জন্য তিনি দশটা মাস অপেক্ষা করে আছেন। তাঁর চোখে এখন লাল-হলুদ অগ্নিশিখা নেচে উঠছে। মেয়েটি দেখল, লোকটা এক হাতে ড্যাগার ধরে অন্য হাতে তার ব্রেসিয়ার ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। সে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর আতঙ্ক তিনি জানকীর চোখে স্বচক্ষে দেখেছেন ভয়, ঘৃণা এবং বাঁচার জন্য। জানকীর অসহায় আর্তি এখনো তাঁর চোখে ভাসছে। জানকীর চোখে ঠিক এমনই আতঙ্ক দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু তার সেই অসহায়ত্ব তাকে বাঁচাতে পারেনি। তাঁর বাঁহাতের এক ঝটকায় ব্রেসিয়ার খুলে গেল। …
ড্যাগারে বিষ মাখানো! ওদিকে তাকিয়ে হরিদাস লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিলেন। একটা মাত্র শব্দ হরিদাসের ওষ্ঠদ্বয় থেকে বের হলো ‘কন্যা।’
হরিদাস দেখতে পেলেন মেয়েটির ব্রেসিয়ারের নিচে একটিও স্তন নেই..কিছু নেই… শুধুমাত্র বীভৎস দুটো গোলাকার, কাটা দাগ।”
(মূল গল্প-খাজা আহামদ আব্বাস, ভাষান্তর জাফর আলম, দাঙ্গার গল্প)
এসব অমানবিক, নির্মম, নিষ্ঠুর ঘটনাকাল গত হয়েছে ৭৪ বছর। এ ৭৪ বছরে পৃথিবীর মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে কতইনা অগ্রসর হয়েছে। ৭০ বছর আগে মানুষ যা কল্পনাও করেনি তেমনও অনেক কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে। এ উপমহাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার কত উন্নতি ঘটেছে। সেই দুটি রাষ্ট্রের একটি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামক আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে তা-ও প্রায় ৪৬ বছর। এর মধ্যে দুই পরাশক্তির একটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। শেষ হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধের। কত আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম হয়েছে, কত মানবাধিকার সংগঠনের জন্ম হয়েছে। রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে কত শান্তি চুক্তি হয়েছে; কত আঞ্চলিক সংস্থা গঠিত হয়েছে তারপরও কি এই উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা দাঙ্গা, হানাহানি দূর হয়েছে? হয়নি। বরং এখন তা আরও দ্রুত ও হিংসাত্মকভাবে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
সাম্প্রদায়িকতার এমন অনেক বীভৎস, কুৎসিত, নির্মম চিত্র আছে। এই চিত্র যারা দেখেছেন তাঁরা তা কখনো ভুলবেন না। শুধু ধর্মীয় পরিচয় ভিন্ন হওয়ার কারণে মানুষকে মানুষ কত ঘৃণা করতে পারে, কত নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে তা ভুক্তভোগীরাই বলতে পারেন শুধু।
সমাজবিদরা বলে থাকেন শত শত বছর ধরে সমাজে একইসঙ্গে বসবাস করার কারণে মানুষে মানুষে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। এ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করেন একধরনের রাজনীতিবিদ, যাদের রাজনীতিই হচ্ছে ধর্মভিত্তিক। কাজেই ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি না করলে এদের রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে না। আরেকটি গোষ্ঠীও ধর্মীয় উম্মাদনা তৈরির পেছনে কাজ করেন যারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সাম্প্রদায়িক। এরা অন্য ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা পোষণ করে। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সাম্প্রদায়িক করে তুলতে, ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ তৈরি করতে মৌলবাদীদের চেয়ে এদের ভূমিকা কম নয়। বরং এরা সমাজে উদার মানুষের মুখোশে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ান। এদের সহজে চেনা যায় না, বোঝা যায় না। একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে যত সহজে চিহ্নিত করে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো যায় এই মুখোশধারীদের তা সহজে করা যায় না। এরা মুখে বিপ্লব আর সমাজ বদলের কথা বলে আর দিনশেষে হিন্দু না মুসলমান সে অংক কষে। চেনা শত্রুকে মোকাবেলা করা সহজ। বন্ধু ও স্বজনবেশে পাশে পাশে থাকা শত্রুকে মোকাবেলা করা কঠিন।
এতকিছুর পরও কিছু কথা থাকে। কিছু কর্তব্য থাকে। অন্য প্রাণির সঙ্গে মানুষের তফাৎটি হচ্ছে মানুষকে মানুষরূপে গড়ে তুলতে হয়, মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হয়। বাঘের বাচ্চাকে বাঘ হয়ে উঠতে শিক্ষা দিতে হয় না। তেমনি করে কুকুর, বেড়াল বা অন্য প্রাণিকেও শিক্ষা দিতে হয় না।
কিন্তু জন্মের পর থেকেই একটি মানবশিশুর যত্ন নিতে হয়, হাঁটাচলা, কথাবলা শেখাতে হয়। পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত করে তুলতে হয়, শিক্ষা দিতে হয়। ভালো আর মন্দের তফাৎ বোঝাতে হয়।
এ প্রক্রিয়া জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হয়। অর্থাৎ একটি মানুষকে মানুষ হয়ে থাকতে নিরন্তর চেষ্টা করে যেতে হয়। এ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তার খোলশটিই শুধু নড়াচড়া করে।
কাজেই মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে কিছু দায় এবং দায়িত্বও আমাদের নিতে হয়। সেটি হলো মানুষকে জাগিয়ে রাখা আর তাকে মানবজন্মেের দায়টি মনে করিয়ে দেওয়া।
তাকে ভালোবাসার কথা বলা। কারণ ভালোবাসা ছাড়া এ মানবজগৎ টিকবে না। আজ মানুষের বড় দুর্দিন। এই নিদানকালে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। মানুষের মাঝে কোনো সীমান্ত নেই, মানুষের কোনো জাত নেই, কোনো রং নেই।
এরপরও কিছু মানুষ ঘৃণা ছড়িয়ে যাবে। আপনি শুধু ঘৃণার বিপরীতে ভালোবাসার কথা বলে যাবেন। এটা আপনার মানবজন্মের দায়।