ইট-সিমেন্টের বস্তিতে মননশীলতার দুর্ভিক্ষ-কামরুল হাসান বাদল

সামরিক শাসকরা অবৈধপন্থায় ক্ষমতায় এসে কমন কিছু কাজ করে। বিশ্বব্যাপী সামরিক শাসকদের এটা বৈশিষ্ট্য বটে। যেমন ক্ষমতায় এসে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান পরিচালনা, অনিয়মকে নিয়মে আনা এবং চোখ ধাঁধানো কিছু উন্নয়ন করা। যদিও এক পর্যায়ে তারা নিজেরাই দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে যায়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে জিয়া-এরশাদের আমলের অবস্থা মনে করলে আমার কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।
ক্যু করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী জেনারেল আইউব খানও সে ধরনের কিছু কাজ করেছিলেন তার মধ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম নিউমার্কেট উল্লেখযোগ্য। আইউব খানের ‘উন্নয়নের এক দশক’ এমন একটি প্রচারণাও ছিল সে সময়। তখন বলা হতো এশিয়ার অন্যতম আধুনিক ও বৃহৎ রেলস্টেশন, সবচেয়ে আধুনিক ও এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ শপিংমল ও হাসপাতাল ইত্যাদি।
অবৈধ ক্ষমতাগ্রহণকে জায়েজ করতে এবং সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করার নিয়তে করা হলেও কিছু কাজ প্রশংসনীয় বটে। যেমন চট্টগ্রাম নিউমার্কেটসহ যে কয়েকটির নাম উল্লেখ করেছি।
১৯৬৪ সাল থেকে নিউ মার্কেটের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই জায়গাটি ছিল একটি চুনার গুদাম। একটি আধুনিক শপিং মল গড়ে তোলার লক্ষে এই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়। সম্ভবত ১৯৬৬ সালে মার্কেটটি উদ্বোধন করা হয়। তখন বলা হতো এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও আধুনিক মার্কেট। কথাটি হয়তো মিথ্যা ছিল না। ফিদা হোসেনের নকশা করা এই মার্কেটটি সবদিক থেকেই ছিল আধুনিক। প্রথম চলমান সিঁড়ি স্থাপিত হয়েছিল এই মার্কেটে। যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে এমনকি অন্য জেলার মানুষও এই মার্কেটে আসতেন। মার্কেটটি উদ্বোধনের আগে এর জন্য সুন্দর নাম দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘বিপণি বিতান’ নামটি তা থেকেই নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং নামদাতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল । ভবনটির স্থাপত্য, নির্মাণ শৈলী সবকিছুই ছিল অত্যন্ত আধুনিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার। মার্কেটটি নির্মাণের সময় পাহাড় কাটতে হলেও কিছুটা বিধান মানার চেষ্টা করা হয়েছিল। মার্কেটের পূর্বদিকটা পাহাড়। যে কারণে মার্কেটটি পশ্চিম অংশ থেকে ধাপে ধাপে পূর্বদিকে উঁচু। ভূমিকম্পে পুরো ভবন যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে কারণে আলাদা আলাদা ভবনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল পুরো মার্কেটটি। এটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন শীতাতপ ব্যবস্থার এত প্রসার ঘটেনি। কিন্তু এই মার্কেট নির্মাণকালে এর ভেতরে যথেষ্ট আলো-বাতাস থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যে কারণে মাঝখানে খালি রেখে বৃত্তাকারে তৈরি করা হয়েছিল মার্কেটটি যেন প্রত্যেকটা দোকান পেছনের অংশ খোলা রেখে বায়ু ও আলোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়া কয়েকটা দোকানের পর খোলা জায়গা ছিল বায়ু চলাচলের জন্য। কেনাকাটা করতে আসা ক্রেতারা যেন বিশ্রাম নিতে পারেন সে পরিকল্পনা মাথায় রেখে। মার্কেটের গোল চত্বরে করা হয়েছিল বাগান। মালামাল পরিবহনের জন্য গাড়ি ও ট্রলি ওঠার ব্যবস্থাও ছিল। দুই সারির দোকানের মাঝখানে চলাচলের প্যাসেজও অনেক প্রশস্ত। মার্কেটের মূল ভবনের পেছনে পাহাড় সংলগ্ন জায়গায় ছিল বি ব্লক। শুনেছি সেখানে কাঁচা বাজারের জন্য দোকান করা হয়েছিল। মার্কেটের টয়লেটও ছিল বি ব্লকে। এখন বি ব্লক ভেঙে সেখানে বহুতল শপিং মল করা হয়েছে। আর -মূল মার্কেটের নকশা পরিবর্তন করে ২য়, ৩য় তলায় টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।
বিপণি বিতানের নকশা বিকৃত করার কাজটি শুরু হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে এরশাদের শাসনামল থেকে। ভেন্টিলেশনের জন্য খোলা রাখা জায়গাগুলো দোকান করে বেচে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই মার্কেটের স্থাপত্যকলার অর্থাৎ মূল নকশাকে এতই বিকৃত ও পরিবর্তিত করা হয়েছে যে এর আসল চেহারা কেমন ছিল তা এখন দেখে বোঝার উপায় নেই। এক সময়ের সবচেয়ে অভিজাত শপিং মলটি এখন জীর্ণ-শীর্ণ হতে চলেছে। এটিও এখন গুদাম ঘরে পরিণত হচ্ছে। ফলে ক্রেতা শূন্য হয়ে পড়েছে এক সময়ের বহুল আকর্ষণীয় বিখ্যাত বিপণি-বিতান।
আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে এখানে। আজকাল তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। মাঝেমধ্যে নিচের তলায় অবস্থিত একটি ব্যাংকে যেতে হয়। কাজ শেষ করে ফিরে আসতে হয় ডানে-বামে তাকানোরও সময় পাই না। দু সপ্তাহ আগে আজাদীর এই কলামে নিউ মার্কেট নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা লিখেছিলাম। তাতে সত্তর ও আশির দশকে নিউমার্কেট কেমন ছিল তার সামান্য বর্ণনা তুলে ধরেছিলাম। লেখাটি পড়ে স্মৃতিকাতর অনেক পাঠক আরও কিছু বিষয় নিয়ে লেখার অনুরোধ করেছিলেন।
কয়েকদিন আগে যেতে হয়েছিল মার্কেটের চার তলায় মোবাইল সংক্রান্ত জটিলতায় পড়ে। কাজ শেষে ভাবলাম চারপাশটা ঘুরে দেখি, হয়ত লেখার আরও কিছু রসদ পেতে পারি। মার্কেটের অবস্থা দেখে মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এক জেনারেলের আমলে গড়ে ওঠা আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী মার্কেটটির ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল আরেক জেনারেল এরশাদের আমলে আর তাতে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিডিএ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া আবদুচ ছালাম। এখন সাবেক হয়েছেন। তিনি শুধু নকশাই বিকৃত করেননি, প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী ও অনন্য নকশার নিদর্শন মার্কেটের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছেন।
বি ব্লকে বহুতল মার্কেট করেছেন সেখানকার দোকানগুলো এখনো চালু হয়নি। বলা যায় লাভজনক হবে না বিবেচনা করে দোকানমালিকরাই চালু করেননি। তারপরও মূল মার্কেটের প্ল্যানকে বিকৃত করে অনেক দোকান করা হয়েছে। এমনকি মোটরসাইকেল ও সাইকেল স্ট্যান্ড ভেঙে সেখানে দোকান করা হয়েছে।
নিউমার্কেট বা বিপণি বিতানের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম ছিল এর দোকান বা ব্যবসার ক্যাটাগরি। কোন ফ্লোরে কিসের দোকান হবে তা নির্ধারিত ছিল। নিয়ম ভেঙে যেকোনো ব্যবসা করার সুযোগ ছিল না। ফলে একটি নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে ব্যবসা করতে হতো। দোকানমালিকরা ছিলেন এসব বিষয়ে সচেতন। বিপণি বিতান মার্চেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন পরে যেটি বিপণি বিতান ব্যবসায়ী সমিতিতে রূপান্তর হলো তা ছিল একটি প্রভাবশালী অভিজাত সংগঠন যার সদস্য হওয়াও ছিল গৌরবের। নিচের তলায় ছিল থান কাপড়, শাড়ি, সেলোয়ার-কামিজ, শার্টিং-স্যুটিংয়ের দোকান। ছিল স্টুডিও, কয়েকটি কসমেটিকসের দোকান। দোতলায় জুয়েলারি, কসমেটিকস, ঘড়ি, স্টেশনারি, বইয়ের দোকান ও বিখ্যাত ডায়মন্ড রেস্টুরেন্ট। বিখ্যাত বইঘরের বিশাল একটি আউটলেট ছিল দোতলায়। তিনতলায় রেডিমেড কাপড়, কসমেটিকস, গৃহস্থালি ও শিশুদের খেলনা ইত্যাদির দোকান আর চারতলায় ছিল একটি কি দুটি বইয়ের দোকান, ক্যাসেট রেকর্ডিং ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রীর দোকান। চারতলায় একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, নামটি মনে নেই। রেস্টুরেন্টটিতে খাবার সার্ভ করতো মেয়েরা। সংকোচের কারণে ওখানে কখনো ঢোকা হয়নি। খর্বাকৃতির এক লোক ছিলেন রেস্টুরেন্টটিতে। মনে আছে, বাইরে বেরুলেই অনেকে লোকটিকে খ্যাপাতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে আসা লোকজন এবং দুবাইওয়লারা ওই দোকানে যেতেন।
দোতলায় বেশ বড়সড় কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল, বুক অরবিট, গুলিস্তান, বুকম্যান ও মনিষা। দোকানগুলোতে প্রচুর বই বিক্রি হতো। বিপণি বিতানের পশ্চিম গেটে ঢোকার মুখে বাম পাশে ছিল পূর্বকোণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ চৌধুরীর বইয়ের দোকান নিউজফ্রন্ট। বিখ্যাত রিডার ডাইজেস্টের পরিবেশক ছিল নিউজফ্রন্ট। সম্ভবত ওই সময়ে সব ব্যবসার লাভের বেশি তারতম্য ছিল না এবং আমাদের মননশীলতারও অবক্ষয় ঘটেনি। ফলে অত্যাধুনিক মার্কেটটিতে অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি বইয়ের দোকানও ছিল। আজ নগরজুড়ে চোখ ধাঁধানো অনেক শপিংমল, সেখানে বিশ্বের নামি-দামি ব্রান্ডের দোকান, ঝলমলে জুয়েলারি শপ, বিদেশি জুতা, সেন্ডেল, চশমা, পারফিউমের রকমারি পশরা কিন্তু কোথাও একটি বইয়ের দোকান নেই। প্রায় ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই নগরে সাতটি বইয়ের দোকান নেই। অক্সিজেন, পতেঙ্গা, মোহরা, হালিশহর এলাকার কোনো ব্যক্তি যদি ২০০ টাকা দামের একটি বই কিনতে চায় তার জন্য তাকে চার থেকে পাঁচ শ টাকা খরচ করে জামালখান-আন্দরকিল্লা এলাকায় আসতে হবে। একা হলে হয়ত গণপরিবহনে আসা যাবে কিন্তু পরিবার বা শিশু নিয়ে আসতে হলে এই পরিমাণ টাকাই খরচ হবে।
নিউমার্কেটের বই দোকানগুলো নেই। সবকটি এখন স্বর্ণের দোকান। বইয়ের চেয়ে স্বর্ণের ক্রেতা বেশি হওয়ায় বা স্বণের্র ব্যবসা অধিক লাভজনক হওয়ায় তা ঘটেছে।
এটি সমাজ পরিবর্তনের একটি চিত্র। অর্থাৎ আমাদের মননশীলতা নিম্নমুখী হয়েছে। সমাজ পূর্বের চেয়ে ভোগবাদী হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানটি গঠন করা হয়েছে নগরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য সেই প্রতিষ্ঠান মানে সিডিএ নিজেদের আইন নিজেরাই ভঙ্গ করেছে। একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার নকশা বিকৃত করে অপরাধ করেছে। আসলে সিডিএ একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। উন্নয়নের নামে পুরো নগর যে ইট-সিমেন্টের বস্তিতে পরিণত হলো তা ঠেকাতে কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নতুন চেয়ারম্যান একদিন ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন সে আশাতেই রইলাম। লেখক : কবি ও সাংবাদিক