অপারেশন সার্চলাইট থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ

অপারেশন সার্চলাইট থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ
»কামরুল হাসান বাদল
কবি,সাংবাদিক লেখক টিভি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব »
১৯৭১ সালের মার্চ। অগ্নিঝরা মার্চ। স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে উত্তাল সময়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসক ইয়াহিয়া খান হলেও দেশ তখন পরিচালিত হচ্ছে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। বস্তুত ক্ষমতায় না থেকেও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন রাষ্ট্রনেতা।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে বাধ্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুকে শাসনভার বুঝিয়ে না দিতে নানান টালবাহানা শুরু করে। ‘শেখ মুজিবই হইবে পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী ’ এমন বক্তব্য দেওয়ার পরও অকস্মাৎ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চের সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলেন।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম সমাবেশে একপ্রকার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাহ্যত আলোচনার কথা বলে এক গভীর ষড়যন্ত্রের ছক কষতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানি জান্তা ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। সেই কালরাতের গণহত্যাকে তারা নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। সে অভিযানে প্রথম রাতেই শুধু ঢাকাতেই অর্ধ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল।
তবে এই অভিযানটির পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ মার্চ। অপারেশন সার্চলাইটের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা ব্যর্থ(?) হলে সামরিক অভিযান চালিয়ে ‘পাকিস্তান সরকারের কর্তৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করা।
সেই ভয়াবহ গণহত্যার পরিকল্পনা কীভাবে হয় তার ধারণা পাওয়া যায় সেসময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার স্মৃতিকথা থেকে।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সামরিক অভিযানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। কয়েকবছর আগে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান, ১৯৬৯-১৯৭১’ -এ লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান টেলিফোনে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজাকে কমান্ড হাউজে ডেকে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় ‘প্রত্যাশিত অগ্রগতি’ হচ্ছে না। যে কারণে এখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশনে’র জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। আর সে কারণে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
সে নির্দেশটি ছিল-
* যে কোন ধরনের বিদ্রোহ বা বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে।
* সফল হওয়ার জন্য আকস্মিক চমক এবং চাতুরির গুরুত্ব আছে। সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও চাতুরির আশ্রয় নিয়ে তাদের সাহায্য করার পরামর্শ দিয়েছিল
* বাঙালি সেনা সদস্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা হবে। বিশেষ করে পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগার, রাজারবাগের রিজার্ভ পুলিশ এবং চট্টগ্রামে কুড়ি হাজার রাইফেলের অস্ত্রভাÐারের নিয়ন্ত্রণ আগেভাগে নিয়ে নেয়া,
* অপারেশন শুরুর সাথে সাথে সব রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নতুন করে যাচাই-বাছাই করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে।
* অস্ত্রশস্ত্র এবং অপরাধীদের খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ঘিরে ফেলতে হবে, এবং তল্লাশি চালাতে হবে।
* শেখ মুজিবকে ধরতে হবে। এর বাইরে ১৫ জন আওয়ামী লীগ এবং কম্যুনিস্ট পার্টির নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে হবে, তাদের কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করতে হবে।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন ব্যারাকে ঘুরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা তদারকি করলেও গোপনীয়তার স্বার্থে অপারেশন সার্চলাইটে অংশ নেয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর কারো কাছেই কোনো লিখিত নির্দেশ পাঠানো হয়নি। শুধু সময় জানিয়ে মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইনের কাছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে ফোনটি এসেছিল ২৫ মার্চ সকাল ১১টায়। তাতে শুধু বলা হয়েছিল, “খাদিম, আজ রাতেই।’
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সিদ্দিক সালিক। তাঁর লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাতে সামরিক অভিযানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের ডিফ্যাক্টো শাসনকে উৎখাত করা এবং সরকারের (পাকিস্তানের) কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।’
২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে পাকিস্তানি জান্তা কর্তৃক গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এবং তাঁর সে ঘোষণা ওয়ার্লেসের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের দ্বারা নিহত হতে পারেন জেনেও জনগণকে অরক্ষিত রেখে, জনগণকে পাকিস্তানি হায়েনাদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাননি। ফলে সে রাতেই তিনি গ্রেফতার হন এবং ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিজীবন কাটান। ১০ জানুয়ারি মুক্ত দেশে ফিরে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর পরের ইতিহাস সবাই জানেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ত্রিশ লাখ শহিদ ও প্রায় চার লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি অর্জন করে তার প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র। কেমন ছিল একাত্তরের দিনগুলো? যারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদেরও কি পুরোটা মনে আছে এখন? একটি দেশের জন্য কী অপরিসীম ত্যাগই না স্বীকার করেছিলেন এ দেশের মানুষরা যাদের অধিকাংশই ছিলেন খুব সাধারণ পরিবারের সন্তান। যে কারণে এই যুদ্ধকে আমরা জনযুদ্ধ বলেও অভিহিত করি।
একজন সাধারণ নারী ভাগীরথী মাতৃভূমির জন্য কী পরিমাণ ত্যাত স্বীকার করেছেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন সে কাহিনীটি অন্তত আরেকবার পড়ুন। আপনার সন্তানকে পড়তে দিন। সে আর যাই করুক সে দেশের মাটিতে যেন পাকিস্তানি পতাকা না ওড়ায় তার জন্য হলেও তাকে আমাদের ত্যাগ ও গৌরবের কথাগুলো বলুন।
পিরোজপুর অঞ্চলের বাগমারা গ্রামের মেয়ে ভাগীরথী। মে মাসের এক বিকেলে সে গ্রামে হানা দিল পাকিস্তানিরা। যাকে যেভাবে পারল হত্যা করল। আগুন দিল মানুষের ঘরবাড়িতে। শুধু ভাগীরথীকে মারল না। রূপলাবণ্যে ভরা মেয়েটিকে ট্রাকে তুলে নিয়ে গেল কদমতলা আর্মি ক্যাম্পে। তার ওপর চলল অকথ্য নির্যাতন, পাশবিক নির্যাতন। সেই পৈশাচিকতার পরেও ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে রইল ভাগীরথী। পাকিস্তানিরা একসময় ক্যাম্পের কাজের মেয়ে হিসেবে ব্যবহার করতে লাগল তাকে। রান্নাবান্নার কাজ করাতে লাগল। ওরা যে যা বলে ভাগীরথী খুব আন্তরিকতা ও দক্ষতা নিয়ে করে দেয়। এভাবে পাকিস্তানিদের আস্থা অর্জন করল সে। কিন্তু তার অন্তরে জ্বলছে ভয়াবহ আগুন। গোপনে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। ভালো খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ৪৫ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে নিয়ে এলো তাদের গ্রামে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের আগেই বলে রেখেছিল। গ্রামে পাকিস্তানিরা ঢোকা মাত্রই আক্রমণ চালাল মুক্তিযোদ্ধারা। ৪০ জন পাকিস্তানিকে হত্যা করল। বাকি পাঁচজন আহত অবস্থায় পালিয়ে গেল।
ভাগীরথী সেদিন থেকে উধাও। কিন্তু উধাও হয়ে বাঁচতে পারল না। তাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এ দেশে সিরাজউদ্দৌলাদের ধরিয়ে দিতে, সূর্য সেনদের ধরিয়ে দিতে বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় না। ভাগীরথীকে ধরিয়ে দেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। তাকে ধরিয় দেওয়া হয়। সে ধরা পড়ে গেল। সেদিন হাটবার। ভাগীরথীকে এনে চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড় করানো হলো। শত শত মানুষের সামনে তার শরীর থেকে খুলে নেওয়া হলো জীর্ণ শাড়ি। দুটো জিপ দাঁড়ানো পাশাপাশি। দুই জিপের মাঝখানে ভাগীরথী। তার দুহাত দুপা বাঁধা হলো দুই জিপের সঙ্গে। চালিয়ে দেওয়া হলো জিপ। পুরনো শাড়ির মতো ছিঁড়ে গেল ভাগীরথী।
এটি শুধু একজন ভাগীরথীর কথা। এমন অসংখ্য ভাগীরথীর কথা এখনও আমাদের অজানা রয়ে গেছে। তা আমাদের তুলে ধরে আমাদের সন্তানদের জানানো দরকার, এঁদের প্রতি আমাদের অশেষ ঋণ আছে। পাকিস্তানি পতাকা ওড়ালে ওদের অপমান করা হয়।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
বুধবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১