পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড়

পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড়
পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে ২২ প্রধানমন্ত্রীর একজনও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। যার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে, অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানকে হটিয়ে দেওয়া।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিতে অস্বাভাবিক নয়। দেশটির রাজনীতি বা ক্ষমতা কোনদিকে যাচ্ছে তা আজ সোমবার তাদের পার্লামেন্ট অধিবেশনের মধ্য দিয়ে খোলাসা হবে। অন্যদিকে ইসলামাবাদের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে ঢাকা।

ইমরান খান ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশটির পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ায় গত ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান সাবেক এই খ্যাতিমান ক্রিকেটার।

মূলত অর্থনৈতিক মন্দা এবং ভুল পররাষ্ট্র নীতির অভিযোগ তুলে বিরোধীরা ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে; কিন্তু ইমরান খান অভিযোগ করেছেন যে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইমরান খানের এই অভিযোগ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।

পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করতে আজ সোমবার দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য দেশটির পার্লামেন্টের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন করেছেন।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে আমরা তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছি।’

সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক গতকাল বলেন, ‘ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটির পর প্রসেস এখনও বাকি আছে। আগামীকাল (আজ সোমবার) পাকিস্তানের পার্লামেন্টে আবার অধিবেশন বসবে। অবাক করার বিষয় হলো যে, আমেরিকানরা কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে এই বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। আবার সৌদি ও ভারতীয়রাও এই বিষয়ে কোনো কথা বলছে না। এই মুহূর্তে ওপেনলি কথা বলছে তুর্কি ও চীনারা। পাকিস্তানে চীনের একাধিক অর্থনৈতিক প্রকল্প রয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়ন। ভূ-রাজনীতিতে চীনের জন্য পাকিস্তানের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের অনেক সাংবাদিক বলছেন যে ইমরান খান চলে গেল, এখন সামনে কী? এখন পাকিস্তানে আবার পরিবারতন্ত্র ফিরে আসতে পারে, বাপ হবে প্রধানমন্ত্রী আর ছেলে হবে চিফ মিনিস্টার অব পাঞ্জাব। আসলে পাকিস্তানের রাজনীতি পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারল না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে অনেকেই বলছেন যে, ইমরান খানের অনেক দোষ থাকতে পারে কিন্তু তিনি দুর্নীতিমুক্ত এবং অনেকেই এই সনদ দিয়েছেন। ইমরান খানের সততার বিষয় অনেকেই উল্লেখ করেছেন। আবার অনেকে বলছেন যে, এই ঘটনায় ইমরান খানের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেছে। গত শনিবার যেটা দেখা গেছে যে ইমরান খানের দল আর্মির বিরুদ্ধে কথা বলছে। আবার আজকে ইমরানের দল বলছে যে না, আর্মি কোনো প্রবলেম না। তাই আসলে পাকিস্তানের রাজনীতি কোনদিকে যাচ্ছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। আগামীকাল (আজ সোমবার) তাদের পার্লামেন্টে কী হয় এবং অন্তর্র্বতীকালীন সময়ে কারা পাকিস্তানের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাচ্ছেন তা দেখার পর খোলাসা হবে।’

ইমরান খানের আবার কী ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? : শহীদুল হক বলেন, ‘আমি মনে করি, নওয়াজ শরিফ এবং ভুট্টোর পরিবার এদের মধ্যে কিন্তু সাপে নেউলে সম্পর্ক। এখন তারা কোথায় গিয়ে যে মিলেছে, কী এজেন্ডা তা এখনও পরিষ্কার নয়। এই সময়ে দুই পরিবারের মধ্যে ঐক্য কোনো আদর্শিক পর্যায় থেকে হয়নি এটা নিশ্চিত। সামনে যখন সরকার গঠন করা হবে, তখন ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। আমার যেটা মনে হচ্ছে, সামনে পাকিস্তানে সাধারণ ভোট অনুষ্ঠান হবে, যদিও সময়টা (কখন হবে) বোঝা যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারিতে ইমরান খান রাশিয়া সফর করেন। ওই সফরে রাশিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান তেল কেনা এবং সস্তায় গম কেনার চুক্তি করে, যা খুবই চমৎকার দুটি চুক্তি। এখন পরিবর্তিত ঘটনায় পাকিস্তানের সামনের সরকার এই দুটি চুক্তি বহাল রাখবে কি না তা দেখার বিষয় আছে। পাকিস্তানের এই ঘটনায় চীনের বেশি মাথা ব্যথা হওয়ার কথা। কারণ ৬০ বিলিয়ন ডলার খরচে পাকিস্তান-চীন ইকোনমিক করিডোর উন্নয়ন হচ্ছে তা সামনে ঝুঁকিতে পড়তে পারে আবার নাও পড়তে পারে। ভারত এখন পাকিস্তান ইস্যুতে একেবারে চুপ আছে। কারণ মাঝে পাকিস্তান-ভারত ইস্যুতে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল তা ইমরান খানের সরকার খুব ঠান্ডা মাথায় সমাধান করেছে। তাই পাকিস্তানের আগামী সরকার এসব ইস্যু কীভাবে সামলাবেন তা পর্যবেক্ষণের জন্য ভারত এখন চুপ রয়েছে।’

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল বলেন, ‘পাকিস্তানকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, তারা হয়তো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ পাকিস্তানে এই ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে। পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই এখন পর্যন্ত তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি, হয় তাদের বিরুদ্ধে ক্যু হয়েছে অথবা সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে তাদের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমার মনে হয়, পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে তাদের সেনাবাহিনী এবং আদালতের মধ্যে এক ধরনের আঁতাত আছে। আর্মি যেটা সরাসরি করে না সেটা আদালতের মাধ্যমে করিয়ে নেওয়া হয়। ইমরান খান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে সম্ভব হলো না।’