বাঙালির নববর্ষ- সম্মিলিত উদযাপন হোক- কামরুল হাসান বাদল

বাঙালির নববর্ষ- সম্মিলিত উদযাপন হোক
কামরুল হাসান বাদল
আমরা পহেলা বৈশাখকে বাঙালি মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে বলে থাকি এই সন প্রবর্তন করেছিলেন একজন মুসলমান, তিনি সম্রাট আকবর কাজেই বাংলা নববর্ষ পালন করলে বেশি গুনাহ হওয়ার সম্ভাবনা নাই। ধারণাটি এমন যে, তার আগে এই ভূখণ্ডে নববর্ষের প্রচলন ছিল না। কিংবা কোনো মুসলমান এটা সংস্কার না করলে তা পালন করা বড় ধরনের গুনাহের মধ্যে পড়ত।
তবে এটা ঠিক যে, সম্রাট আকবর একটি সংস্কার করেছিলেন তবে সে সংস্কার তার ধর্মীয় ভেদরেখার বাইরে যেতে পারেনি। তিনি অগ্রহায়ণ থেকে বছরের শুরু বৈশাখে নিয়ে গেলেন কিন্তু সাল গণনার ভিত্তি করলেন মুসলমানদের হিজরি সনের সঙ্গে সামঞ্জস রেখে। হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ হওয়ায় ১১ দিন কম সূর্যসনের চেয়ে। সে কারণে হিজরি সন বর্তমানে বাংলা সন থেকে ১৫ বছর এগিয়ে গেছে (আকবরের সময় থেকে হিসাব করলে)। বাংলা দিনপঞ্জীর সাথে হিজরী এবং খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর আর খ্রিস্টীয় সনে নতুন দিন শুর হয় ইউটিসি±০০:০০ অনুযায়ী। ঐতিহ্যগত ভাবে বাংলা সন অনুযায়ী সূর্যোদয় থেকে দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।
একসময় এই অঞ্চল বর্তমান মানচিত্রের মতো ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত জনপদগুলোর নামও ছিল ভিন্ন। যেমন, বঙ্গ, হরিকেল, সমতট, বঙ্গাল, পুণ্ড্র, বরেন্দ্রী, রাঢ়া, সুহ্ম, বজ্রভূমি, বর্ধমান কঙ্কগ্রাম, তাম্রলিপি, গৌড় ও বাংলা । এর মধ্যে বিভিন্ন সনেরও প্রচলন ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মেরও প্রচলন ছিল। মোগল সম্রাটরা ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো জয় করে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে এনেছিলেন। ড. নিহাররঞ্জন গুপ্ত লিখেছেন, ‘গৌড় নামে বাংলার সমস্ত জনপদকে ঐক্যবদ্ধ করার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করেছিলেন, তাতে কাজ হল না। যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত, যা ছিল পাল ও সেন আমলে কম গৌরবের ও আদরের -সেই বঙ্গ নামেই শেষ পর্যন্ত তথাকথিত পাঠান আমলে বাংলার সমস্ত জনপদ ঐক্যবদ্ধ হল। আকবরের আমলে গোটা বাংলাদেশ সুবা বাংলা বলে পরিচিত হল। ইংরেজদের আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ; অবশ্য আকবরের আমলে সুবা বাংলার চেয়ে আজকের বাংলা আয়তনে অনেক ছোট।’
সম্রাট আকবর সারা ভারত শাসন করলেও তিনি কেন শুধু বাংলা সনের সংস্কার করলেন তা আমি এখনো বুঝতে সক্ষম হইনি। বাংলা সনের সংস্কার করলেও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলগুলো সে সময় কোন ক্যালেন্ডার অনুসরণ করতো তার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাচ্ছি না। অনেকে বলেন, সে সময়ও অনেকে স্থানীয় বর্ষপদ্ধতি অনুসরণ করতো।
বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে ওঠার ইতিহাস কবে থেকে? সোজা উত্তর হতে পারে বাংলাভাষার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতিরও পথ চলাও শুরু। এ বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজের মিলও ছিল না। তবু এর মধ্যে এক ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।’
রবীন্দ্রনাথের এই কথাটি কতটা খাঁটি তার প্রথম প্রমাণ মেলে বাংলার ভাষা আন্দোলন থেকে। নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের সে সংগ্রামে পূর্ববাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তো ছিলই তার সঙ্গে বিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের সমর্থন ছিল ওই চেতনা থেকে উৎসারিত, যা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘আমরা বাংলা বলে থাকি।’ ঘটনা এখানে শেষ হয়নি ভাষা রক্ষার সে আন্দোলন সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে পর্যবেশিত হয়েছে এবং সে জাগরণ বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন রোপণ করে দিয়েছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হলো বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র, ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
বিশ্বের প্রায় সব দেশ যে ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে তাকে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার বলে। তবে এটিও বেশ কয়েকবার পরিমার্জনা করে আধুনিক বা বিজ্ঞানসম্মত করে তোলা হয়েছে। তদ্রুপ একসময় বাংলা সনকেও আধুনিক বা বিজ্ঞানসম্মত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুরু থেকে হালআমল পর্যন্ত তার সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সংস্কারের কাজটি শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপরই। ১৯৫০-এর দশকে প্রখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে ভারত সরকার ভারতবর্ষের দিনপঞ্জিকা সংস্কারের কমিটি গঠন করে। মেঘনাদ সাহা কমিটি ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রচলিত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিকার আমূল পরিবর্তন করে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রস্তাব পেশ করেন। এই কমিটির প্রস্তাব ছিল, বৈশাখ থেকে ভাদ্র— এই পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
আশ্বিন থেকে চৈত্র— এই সাত মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
সাহা কমিটির প্রস্তাবসমুহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ভারত সরকার এস পি পাণ্ডের নেতৃত্বে আশির দশকে আরেকটি কমিটি করে। এই কমিটি মেঘনাদ সাহার প্রস্তাবসমূহকে মূল ধরে ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসাবে নির্ধারণ করে প্রস্তাব পেশ করে। এটা গেল ওপার বাংলার কথা। বাংলাদেশও বেশ কয়েকবার বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে বাংলা একাডেমি কমিটি গঠন করে যাকে ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে অভিহিত করা হয়। এই কমিটি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সুপারিশকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে। এই কমিটি আধুনিক গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি রীতি অনুসারে রাত ১২টা থেকে দিনের সুচনা করার অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তনের প্রস্তাব দেয়। প্রচলিত নিয়মে যা চিল সুর্যোদয়ে দিনের শুরু অর্থাৎ তারিখ পরিবর্তিত হওয়া।
দেশে বিদ্যমান অনেক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে হঠাৎ করে শহীদুল্লাহ কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে এর ভিত্তিতে বাংলা দিনপঞ্জিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এর পরেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিকাকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক করার জন্য ১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, ভাষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই কমিটি মেঘনাদ সাহা ও শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে ২০টি সুপারিশ পেশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুনকে অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিতে যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস অধিবর্ষ হবে, সেই বছর বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ফাল্গুন মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে হবে ৩১ দিন।
তারপরেও জাতীয় দিবসগুলোয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মূলানুগ না হওয়ায় জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো দুটো বর্ষপঞ্জিতে আলাদা দিনে পড়তো। যেমন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা বর্ষপঞ্জির পাতায় দিনটি ৮ই ফাল্গুন হলেও ২০১৫ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে তা পড়ে ৯ই ফাল্গুন। বাংলা বর্ষপঞ্জির এমন বিদ্যমান অসামঞ্জস্য দূর করে পুরোপুরি বিজ্ঞানভিত্তিক এবং জাতীয় দিবসগুলোকে মূলানুগ করতে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায়, পদার্থবিজ্ঞানী জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর, একাডেমির পরিচালক অপরেশ কুমার ব্যানার্জি প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে তৃতীয়বার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটি কমিটি করা হয়। এই কমিটি প্রধানত বিশেষ দিনগুলোয় গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জিকে ও বাংলা বর্ষপঞ্জিকে মূলানুগ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করে। এই কমিটির প্রস্তাবসমূহ- বৈশাখ থেকে আশ্বিন— এই ছয় মাস ৩১ দিন গণনা করা হবে।
কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র— এই পাঁচ মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে।
ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে।
খ্রিষ্টাব্দের অনুগামী বছরে ফাল্গুন মাসে বঙ্গাব্দের অধিবর্ষ হবে অর্থাৎ যে খ্রিষ্টাব্দে অধিবর্ষ হবে সেই বাংলা বছরে ফাল্গুন মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে।
বাংলাদেশে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে শামসুজ্জামান খান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। বর্তমানে সরকারিভাবে এই বর্ষপঞ্জিই চালু আছে।
আধুনিকতার অর্থ হলো পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া এবং যুগের প্রয়োজনে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া। সে হিসেবে বর্ষপঞ্জি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করার বিষয়ে কারুর বলার কিছু নেই কিন্তু সে পরিবর্তন বা সিদ্ধান্ত যদি বিভাজন তৈরি করে, জাতিসত্বার মধ্যে ভেদরেখা তৈরি করে সেক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া জরুরি ছিল। বাংলা নববর্ষ শুধু বাংলাদেশের উৎসব নয়, এ উৎসব সর্ববাঙালির। কাজেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওপার বাংলার বিশিষ্টজনদের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এটাকে তড়িঘড়ি করে বিভক্ত করার পেছনে যে সৎ উদ্দেশ্য ছিল না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এরশাদ অনেক অপকর্মের স্রষ্টা। এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী। বাঙালি জাতির বর্ষপঞ্জি বদলানোর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তার হাত ধরে হবে কেন? যে নিজেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না। এর মাধ্যমে এরশাদ দুই বাংলা স্পষ্ট করে বলতে গেলে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি অমুসলিমদের মধ্যে একটি বিভক্তির দেয়াল তুলে দিয়েছেন। যেহেতু বিষয়টি দুই বাংলা সম্পর্কিত একটি স্পর্শকাতর বিষয় সেহেতু তার জন্য আরও ব্যাপক আলোচনা এবং ঐকমত্যের প্রয়োজন ছিল।
বর্ষবরণের উৎসব করি বটে কিন্তু আজ আমাদের পহেলা বৈশাখ কাল আপনাদের একথা বলতে বা শুনতে ভালো লাগে না।
আমি জানি না, এই বিভক্তি কাটিয়ে তোলার প্রয়াস কেউ নেবেন কিনা।
তারপরও বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবের সাফল্য কামনা করি। তারপরও নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
লেখক, কবি ও সাংবাদিক