»অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মদিন আজ

কাবুল দত্ত/ এস আহমেদ ডেক্সঃ আজ ০৫ মে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ বিপ্লবী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর ১১১ তম জন্মদিন।ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার “প্রীতিলতা ওয়াদ্দের” নামেও পরিচিত ছিল। তার ডাকনাম ছিল রাণী। বিপ্লবীরা তাঁকে ছদ্মনামে ডাকতো ফুলতার বলে। প্রীতিলতা বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে তাঁর মাতুলালয়ে সাহসি, সংগ্রামী এই বাঙালি রমনী জন্ম গ্রহন করেন ১৯১১ সালের এই দিনে।
তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালি বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন করেন
এক নজরে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদর :
শিক্ষাজীবনে অত্যন্ত মেধাবী প্রিতীলতা ১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস সহ চট্টগ্রাম শহরের ড. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৩০ সালে ঢাকার ইডেন কলেজ হতে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সকলের মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি ও পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজ়ে বি এ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে বেথুন কলেজ হতে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন। কিন্তু বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে বিএ পাস করলেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তিতে তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তর পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখে। অবশেষে কলিকাতা বিস্ববিদ্যালয় ২২ মার্চ, ২০১২ সালে বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে এই বিপ্লবী কন্যাদ্বয়ের স্নাতক ডিগ্রী পুন: বহাল করেন।
।এই বীরকন্যা কলকাতার বেথুন কলেজ হতে ১৯৩২ সালে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করে চট্রগামে চলে আসেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনকে চোখে দেখার ব্রত তিনি আগেই নিয়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল তাঁর নির্দেশে দেশ মাতৃকার জন্য একটা কিছু করার। এসে যোগ দেন চট্টগ্রামের অর্পণাচরণ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে।
মৃত্যুর আগে তিনি মায়ের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদো না! আমি যে সত্যের জন্য, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী বিদেশির অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভাবে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা! তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্য উত্সর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?’ শুধু তার মা নয়, আজও অসাধারণ সাহসী সেই নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে অশ্রুসজল চোখে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন দেশপ্রেমী মানুষ। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামে পাহাড়তলীস্থ ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত হলে সূর্যসেন এই অভিযানের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন প্রীতিলতাকে। তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড়ঘেরা এই ক্লাবের চতুর্দিকে ছিল প্রহরী বেষ্টিত। একমাত্র শ্বেতাঙ্গরা এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া এদেশীয় কেউ ঐ ক্লাবের ধারে কাছে যেতে পারতো না। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। এই ক্লাবের ফটকে লেখা ছিল “কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ”! ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের আগে চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণ কাট্টলীতে যোগেশ মজুমদার নামের ঐ ক্লাবেরই একজন বেয়ারার বাড়িতে বিপ্লবীরা আশ্রয় পেলেন। যোগেশ মজুমদার ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের ব্যাপারে বিপ্লবীদের সহায়তা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপিয়ান ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বিধায় প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। সে দিনের আক্রমণে প্রীতিলতার সাথে যারা ছিলেন তারা হলেন- কালী কিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী (এদের পরনে ছিল- ধুতি আর শার্ট), মহেন্দ্র চৌধুরী, সুশীল দে এবং পান্না সেন (এদের পরনে ছিল- লুঙ্গি আর শার্ট)! বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা যোগেশ মজুমদার প্রথমে ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখিয়ে দেন এবং এর পরেই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় ৪০জন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ শুরু করেন। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলবার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী এবং কালী কিংকর দে। ওয়েবলি রিভলবার নিয়ে সুশীল দে এবং মহেন্দ্র চৌধুরী ক্লাবের দক্ষিণের দরজা দিয়ে এবং পিস্তল নিয়ে বীরেশ্বর রায়, রাইফেল আর হাতবোমা নিয়ে পান্না সেন আর প্রফুল্ল দাস ক্লাবের উত্তরের জানালা দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছিলেন। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ইউরোপিয়ান ক্লাব কেঁপে উঠেছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাওয়ার কারণে ক্লাবে উপস্থিত থাকা সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার থাকায় তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন আর্মি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার দেহের বাম পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটির সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। সেই দিনের আক্রমণে মূলত অনেক ব্রিটিশ নিহত হলেও পুলিশের রিপোর্টে মাত্র ১জন নিহত ও ১১জন আহতের খবর প্রকাশ করা হয়।

পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পুলিশ এর হাতে ধরা দেয়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় জ্ঞান করে পূর্বসিদ্বান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাসিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালী কিংকর দে’র কাছে তিনি তাঁর রিভলবারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে, কালী কিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন।

ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তীতে প্রীতিলতাকে সনাক্ত করেন। তাঁর মৃতদেহ তল্লাশীর পর পাওয়া যায় সেই ছোট্ট চিরকুট, যার কথা আগেই বলা হয়েছে।

আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এই বিপ্লবী বীরকে।