বিত্তের বুভুক্ষা বনাম চিত্তের বৈভব

কামরুল হাসান বাদল কবি, সাংবাদিক, লেখক

কোরবানি ঈদের কয়েকদিন আগে সামান্য কেনাকাটার জন্য আড়ংয়ে গিয়েছিলাম। রাত আটটার মধ্যে আউটলেটটি বন্ধ করার সরকারি নির্দেশনা থাকায় দ্রুত সদাই সেরে বেরিয়ে আসতে হলো। হাতে সময় থাকায় কিছুটা পথ হাঁটব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। সামান্য অগ্রসর হতেই বিপ্লব উদ্যান দেখে স্ত্রীকে বললাম অনেকদিন এখানে আসিনি একটু ঘুরে দেখি।
উদ্যানে ঢুকেই বিস্মিত হলাম সারিসারি খাবারের দোকান, সেসবের সামনে শানবাঁধানো চকচকে আসনগুলোতে প্রচুর ভোজনবিলাসী লোকজন দেখে। দোকানের কর্মচারীরা বিভিন্ন খাবারের নাম বলে বলে তাদের দোকানের সামনের আসনে বসার আহ্বান জানাচ্ছিল। আসলে আহ্বান না বলে বলা উচিত জোরাজুরি করছিল। তা উপেক্ষা করে আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে খোলা স্থানটি দেখার চেষ্টা করলাম। দেখে হতাশ হলাম। খোলা স্থানটি একপ্রকার পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় মালপত্রে ঠাসা মাঠে সবুজ কিছু ঘাস কোনোভাবে টিকে আছে। এই খোলা চত্বরটি যা একসময় খোলা পার্ক ছিল, ঘাস আর ফুলগাছে শোভিত ছিল, যেখানে আগে প্রতিদিন অজস্র মানুষ বিনাবাধায় সময় কাটাতো সে পার্কটি বা সবুজ খোলা স্থানটি আজ ফুডজোন হয়ে উঠেছে। খাবারের দোকান বা বাণিজ্যিক লক্ষ্য ছাড়া এই জায়গাটির কোনো দাম যেন নেই কর্তৃপক্ষের কাছে। আমি বেশ কিছুটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন মনোরম সান্ধ্যসময়ে খোলা স্থানে তেমন লোকজন নেই। ভাবছিলাম এমন সময়ে, এমন স্থানে তো প্রাণের বন্যা বয়ে যাওয়ার কথা। কোথায় ছেলেমেয়েরা বসে হইচই করবে, গলা ফাটিয়ে গান করবে, কবিতা আউড়াবে, গিটারে সুর তুলবে। হায় সময়! বদলে যাওয়া সময়! সেসবের কিছুই এখানে নেই। তাদের অনেকেই ফুড জোনে দামি খাবার খাচ্ছে। মন খারাপ করে ফিরে আসার পথে বেবিট্যাক্সি থেকে স্ত্রীকে সড়কের দু’পাশে খাবারের দোকান আর বিভিন্ন দামি ব্রান্ডের শোরুম দেখাতে দেখাতে বললাম, খাওয়া আর কেনাকাটা ছাড়া এ নগরবাসীর আর কি কোনো বিনোদন নেই? তরুণদের কাছে রেস্টুরেন্টে খাওয়াটাই এখন একমাত্র বিনোদন? সে দুই নম্বর গেট এলাকা থেকে জামালখান অবধি শুধু যেন খাবারের দোকানই দেখলাম। তবে জামালখানে খাবারের দোকানের পাশাপাশি প্রচুর ওষুধের দোকানও দেখলাম। (দুটোই একটি সুস্থ জাতির লক্ষণ নয়) এর মধ্যে বাতিঘর ছাড়া কোনো বইয়ের দোকান বা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের কিছুই চোখে পড়ল না।
অথচ একটি মেট্রোপলিটান নগরীতে কত বৈচিত্র্যই না থাকার কথা। ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য, উৎসব ও আয়োজনের বৈচিত্র্য, জীবনযাপনের বৈচিত্র্য, পোশাক-আবরণের বৈচিত্র্য। দুঃখজনক! শুধু খাবারের বৈচিত্র্য ছাড়া অন্যকিছুই এই নগরে বিদ্যমান নয়।
এই নগরে কয়েকশত মার্কেট ও শপিংমল আছে। সেখানে নামি-দামি নানা ব্রান্ডের পোশাক, জুতা, কসমেটিকস, বেল্ট, মানিব্যাগের আউটলেট আছে। আছে জুয়েলারি, শাড়ি ও বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের দোকান। এ ছাড়া আছে খাবারের দোকান, শপিংমলে আছে আলাদা ফুডজোন। কিন্তু কোথাও কোনো বইয়ের দোকান নেই। কোনো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টের শোরুম নেই। আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা, অক্সিজেন, বালুছড়া, চাঁদগাও, বাকলিয়া জুড়ে যে বিশাল নগরী যেখানে ৬০/৭০ লাখ মানুষের বাস সেখানে বইয়ের দোকান আছে কয়টি? বাদ্যযন্ত্রের বিক্রেতা আছে ক’জন? উক্ত এলাকার একজন বাসিন্দাকে একটি বই কেনার জন্য আসতে হবে জামালখান এলাকা বা তার আশেপাশে। এই যে বিশাল শহর এখানে কোনো পার্ক নেই, খোলা উদ্যান নেই, উন্মুক্ত জলাশয় নেই, খেলার মাঠ নেই, সিনেমাহল নেই, থিয়েটার নেই, সংগঠন নেই, সংস্কৃতিচর্চা নেই, মুক্তমঞ্ছ নেই, চিত্তবিনোদনের কোনে ব্যবস্থা নেই, বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। আগে পাড়ায় পাড়ায় সংগঠন ছিল, শিশুসংগঠন ছিল, সরকারি অফিসে অডিটোরিয়াম ছিল, বিভিন্ন কলোনিতে কমিউনিটি সেন্টার ছিল যেখানে বছরজুড়ে থাকতো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অফিসপাড়ার নাটক ছিল বিখ্যাত। মুসলিম হল প্রায় বছরজুড়ে এমন নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখর থাকত। আজ সেসবের কিছু নেই। সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলি বা চর্চা বলি তা শহিদমিনার চত্তর থেকে মুসলিম হল, ডিসি হিল, চেরাগী পাহাড়, প্রেস ক্লাব হয়ে শিল্পকলা একাডেমি পর্যন্ত।
এতসব ‘নেই’- এর মধ্যে আছে ব্যাপক দুর্নীতি, অনাচার, অনিয়ম, লুটপাট, ধর্ষণ, বলাৎকার, দখল-দূষণ, চাঁদাবাজি, রাহাজানি, মাস্তানি, হত্যা, কূপমন্ডুকতা, সামপ্রদায়িকতা, হানাহানি, হিংসা-ঘৃণা, নকল-ভেজাল ইত্যাদি। আর এসবকিছুই বেড়েছে সমাজে সংস্কৃতিচর্চা কমে গেছে বলে। সংস্কৃতি মানুষের ভেতর মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে। উদার, মানবিক ও পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠতে সাহায্য করে। মানুষে মানুষে দূরত্ব, ঘৃণা ও বিভাজন দূর করে। মানুষকে প্রগতিশীলতার দিকে ধাবিত করে। সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, প্রতারক চক্র, সামপ্রদায়িক চক্র ও দুর্নীতিবাজ লুটেরাশক্তি সংস্কৃতির জাগরণকে ভয় পায় তাই তারা প্রতি পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে, শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার বিরোধিতা করে। বাংলাদেশে আজ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তা সমাজে সংস্কৃতিচর্চা ব্যহত হওয়ার ফল। কোনো গবেষণার দরকার নেই এই তুলনাটি করলেই হবে, যখন আমরা দল বেঁধে সিনেমা দেখতাম, পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তখন সমাজ কেমন ছিল আর সব প্রায় বন্ধ করে দিয়ে আজকের সমাজ কেমন আছে। এ সময়ের উঠতি বয়েসি কিশোর-তরুণরা কী করে? তারা সময় কাটায় কী করে? আসলে স্বাভাবিক উপায় যদি না থাকে তখন বিকল্প খোঁজে মানুষ। যেমন এরাও খুঁজে নিয়েছে। ওরা বাইরে খেলতে না পেরে ঘরে বসে মোবাইলে গেম খেলে। অনেকে বসে বসে ওয়াজ দেখে, পর্নো ছবি দেখে। আমি লক্ষ্য করি শহরের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ-তরুণীরা জামালখান ও চেরাগী পাহাড়ের দিকে আসে তাদের মধ্যে অনেককে দেখি কোনো মার্কেট বা দোকানের সিঁড়িতে বসে বসে নিজে ফেসবুক চালায়। তারপর একসময় ঘরে ফেরার পালা এলে পরস্পর থেকে বিদায় নিয়ে যে যার গন্তব্যে পা বাড়ায়। বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে, আড্ডা হবে বলে যে এতদূর আসা তা না করে এখানেও তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তুমুল আড্ডাবাজি যাকে বলে তারা তা জানেও না, করেও না। আড্ডা খারাপ কিছু নয়, আড্ডা মানুষকে জাগিয়ে তোলে, সৃজনশীল করে, ঋদ্ধ করে, উদ্যোমী করে। তারা আড্ডার প্রকৃত স্বাদ থেকেও বঞ্চিত। তবে এজন্য আমি সে তরুণদের দায়ী করি না। দায়ী করি না কারণ সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থাই তাদের এই প্রবাহে ঠেলে দিয়েছে।
এটা গেল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও তাদের সন্তানদের কথা। এর পাশাপাশি এই শহরে দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিক, রিকশা-ঠেলাগাড়িচালক, হকার, ফুটপাতের দোকানি এবং অন্যান্য সাধারণ পেশার কয়েক লাখ মানুষ। সেসব মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা কী? আমি চারপাশে লক্ষ্য করে দেখি ওদের মধ্যে যারা মোবাইলে আগে গান বাজাত তারা এখন ওয়াজ শোনে। এসব ওয়াজে যে সবসময় ভালো কথা বলা হয় তা নয়। নানা প্রকার উসকানিমূলক ও আপত্তিকর কথাবার্তাও এখানে বলা হয়। এ লোকদের অনেককে দেখি আড়ালে আবডালে পর্নো ছবি দেখে। আসলে সে করবেই বা কী? সারাদিন পরিশ্রম করা লোকগুলোর বিনোদনেরও তো কোনো ব্যবস্থা নেই সমাজে, রাষ্ট্রে।
ব্রিটিশরা পড়ুয়া জাতি। তাই তারা যখন উপমহাদেশে রেল যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলে তখন তারা প্রতিটি রেলস্টেশনে বুকস্টল চালু করেছিল। বড় স্টেশনে কয়েকটি বুকস্টল থাকতো ছোট স্টেশনে কমপক্ষে একটি বুকস্টল থাকতোই। শুধু ব্রিটিশরা নয় উন্নত বিশ্বের প্রতিটি জাতি বই পড়ে। ট্রেনে, ট্রামে, মেট্রো, প্লেনে, পার্কে যেখানেই অবসর মেলে মুখের ওপর একটি বই খুলে রাখবেই। বাঙালি বই পড়ে না, বই কেনে না। সে নিয়ে বাঙালি মনিষীদের আক্ষেপের শেষ ছিল না। কিন্তু বাঙালির স্বভাব বদলায়নি। বরং দিনদিন অবস্থার অবনতিই হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার বিত্তের বুভুক্ষা সমাজকে ভোগবাদী করে তুলবে। ভোগবাদী সমাজ মানুষের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দিয়ে একটি দানবীয় সমাজ গড়ে তুলবে। এর বদলে যদি চিত্তের বৈভব ঘটাতে না পারি তাহলে এ সমাজ অন্ধকারের অতলে তলিয়ে যাবে তাকে রক্ষা করার উপায় থাকবে না।
লেখক : কবি সাংবাদিক