ডেঙ্গু ডেঙ্গু ডেঙ্গু- বাঁচতে চাই-লেখক রোকসানা বন্যা

 

সরকারি তথ্যমতে, পত্রিকার সূত্রে জানা যায় ডেঙ্গুতে ৯শ মৃত্যু ছড়ালো। অজানা আরো অনেক মৃত্যু থেকে যায় আমাদের আড়ালে। কারণ ডেঙ্গুর সিনড্রোম ভিন্নরূপে আসছে। খুব বেশি জ্বর না হলে, অনেকদিন পর্যন্ত রয়ে গেলে তারপরই পরীক্ষা করানো হয়। খুব যারা সচেতন তারা হয়তো পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে নেয়। এইভাবে ডেঙ্গুর অনেক মৃত্যু আড়ালে থেকে যায়। এটা করোনা মহামারির চেয়েও কম নয় কিন্তু।
ডেঙ্গু জ্বর একটি এডিস মশা বাহিত ভাইরাস। বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগ। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে সচরাচর ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে লালরঙের দানার মতো দেখা যায়। দুই থেকে দশ দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে। যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্ত অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্তে প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। আবার কখনোবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়।
ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে, তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে থাকে।
জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেটে তীব্র ব্যথাও হতে পারে।শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়াও মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। এই জ্বরের আরেক নাম ব্রেক বোন ফিভার। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ। যা অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। পাশাপাশি বমি বমি ভাব, এমনকি বমিও হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে ও রুচি কমে যায়।
স্ত্রী মশা ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। যেগুলোর মধ্যে এডিস ইজিপ্টি মশা প্রধানতম। ভাইরাসটির পাঁচটি সেরোটাইপ পাওয়া যায়। ভাইরাসটির একটি সেরোটাইপ সংক্রমণ করলে সেই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে রোগী আজীবন প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপের বিরুদ্ধে সাময়িক প্রতিরোধী ক্ষমতা অর্জন করে।
পরবর্তীতে ভিন্ন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমিত হলে রোগীর মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কয়েক ধরনের টেস্টের মাধ্যমে যেমন, ভাইরাসটি বা এর আরএনএ প্রতিরোধী এন্টিবডির উপস্থিতি দেখেও ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয় করা যায়।
অ্যাডিস নামে মশাগুলো অন্যান্য মশার চেয়ে বড় এবং গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। এরা বৃষ্টি-পরবর্তী সময়ে যেকোনো জলাবদ্ধ এলাকায় বংশবিস্তার করে। তা ছাড়া ঘরে রাখা টব বা ফুলদানির পানিতেও এরা বংশবিস্তার করে। ইদানিং শোনা যায়, নালা, ডোবার পানিতেও বংশবিস্তার করছে। যার ফলে এই ছোট্ট একটা প্রাণী কোথায়, কখন আপনাকে কামড়িয়ে বসবে টের পাওয়াই মুসকিল।
এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে শুকনো মওসুমে এ মশা কমে যায়। যেকোনো অ্যাডিস মশা কামড়ালেই ডেঙ্গু হয় না। যে মশা জীবাণু বহন করে, শুধু সেসব মশার কামড় থেকেই ডেঙ্গু হতে পারে। এ মশা দ্বারা রোগ বিস্তারের আরেকটি অবাক হওয়ার মতো তথ্য হলো সাধারণত দিনের বেলায় অ্যাডিস মশা কামড়ায় এবং ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণ হয় দিনের বেলায়। অবশ্য এই ভাইরাস রূপ পরিবর্তন করছে বলেও জানা যায়।
শুরুতেই ডেঙ্গু জ্বর আমাদের দেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে এই ডেঙ্গু। যার ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে আতংকগ্রস্ত। এমনকি রোগাক্রান্ত ব্যক্তি এবং পরিবার-পরিজন অনেকেই হয়ে পড়েন দিশেহারা। শত শত রোগীর রক্ত এবং রক্তের প্লাটিলেট জোগাড় করতে গিয়ে ব্লাড ব্যাংকগুলো রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে।
রক্ত বা প্লাটিলেট সংগ্রহ করার জন্য লোকজনও হয়ে উঠেছিল মরিয়া। প্লাটিলেট দশের নিচে নেমে এলে রোগী অবস্থা ভয়াবহ হয়। রোগীকে বাঁচানো কষ্ট হয়ে পড়ে।
এ সময়টাতে চিকিৎসকেরাও অসহায় হয়ে পড়ে। ফলে পরিবার আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বদলে যাচ্ছে এ সময়ের ডেঙ্গুর উপসর্গ। যে কারণে ডেঙ্গুজ্বর অনেক সময় মারাত্মক সমস্যা ডেকে আনে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসা না নিলে ভয়াবহ বিপদ হতে পারে। ডেঙ্গুর আক্রমণ হলে ফুসফুসের জটিলতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই শুরুতেই সাবধান হতে হবে। হাঁপানি, সিওপিডির মতো ফুসফুসের ক্রনিক অসুখ থাকলে জ্বর হলেই সতর্ক হতে হবে। তাই সর্দি-কাশি, কাশির সাথে বুকে ব্যথা, কফ ওঠা এবং শ্বাসকষ্ট হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে নিউমোনিয়ার জীবাণুর সংক্রমণ হলে রোগীর অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ে।
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা খুব বাড়ছে। মশাবাহিত এ রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় করা না হলে, মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
কবে আমরা এর সুফল ভোগ করবো জানি না। এই ছোট্ট একটা প্রাণীর কাছে সবাই জিম্মি। এর জন্য দায়ী আমরাও। যত্রতত্র নির্বিকারভাবে আমরা ঘর সাফ করে ডাস্টবিনে ফেলি। কিন্তু কিছু জিনিসপত্র আছে যেগুলোতে পানি জমে থাকে। তা দেখেও এড়িয়ে যাই। দোকান, ভ্যানগাড়ির সামনে ময়লার স্তুপে পানি জমে থাকে। এইসব ব্যাপারে একটু সতর্ক হলে ডেঙ্গু থেকে রেহাই পাওয়া যেতো।
সিটি কর্পোরেশনের কাজ এইসব দেখা। ওনারা কী যে দেখেন তাও বুঝি না। মশক নিধনের কাজটাও সঠিকভাবে করছেন না। আমরা ছোটকালে দেখতাম ঘরে, ঘরের বাইরে এসে দু’একদিন পর-পর ওষুধ ছিটাতো। তখন তো ডেঙ্গুই ছিলো না, আবার এতো মানুষও ছিলো না। এখন কালেভদ্রে দেখা পাওয়া যায় মশক নিধনের যন্ত্র। ওনারা রাস্তায় ওষুধ ছিটায়, আর মশারা উড়ে আসে ঘরে। তারপর তো যা হওয়ার তাই হয়। দিনে, রাতে মশা মারতেই হয় ঘরে বসে হাতের তালু দিয়ে।
প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে ছাদবাগান আছে। সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে, সিটি করপোরেশন নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে এই মশা থেকে বাঁচা যেতো। অল্পসল্প জরিমানা করে ছেড়ে দিলে, দু’একদিন অভিযান পরিচালনা করলে হবে না। মশাও বুদ্ধিমান। সেও বোঝে। তাকে বিনাশ করা সহজ নয়। ডিম ফোটাতে সময় লাগে না বেশি। বিনাশ করতে হলে সম্মিলিতভাবে এগোতে হবে সবাইকে নিয়ে। তাহলেই আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারবো।

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক