কামরুল হাসান বাদল ,লেখক : কবি ও সাংবাদিক ও টিভি ব্যক্তিত্ব»
১. আমরা এত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছি যে, এখন কথা বলার ক্ষেত্রে করছি তর্কাতর্কি, তর্কাতর্কির ক্ষেত্রে করছি কলহ, কলহের ক্ষেত্রে করছি মারামারি, মারামারির ক্ষেত্রে করছি খুনোখুনি। সমাজের উচ্চ শ্রেণি থেকে শুরু করে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত পরিলক্ষিত হচ্ছে এই চিত্র, এই পরিস্থিতি। আমাদের মধ্য থেকে লোপ পেয়েছে সৌভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, মমতা ও ভালোবাসা। পরস্পরের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সমীহভাব প্রদর্শনে আমরা ভীষণ কৃপণ হয়ে উঠছি। আর এর ভয়াবহ শিকার হচ্ছে দেশের শিশুরা। তারা একটি অমার্জিত, অভদ্র, অশোভন পরিবেশে বড় হয়ে উঠতে উঠতে নিজেরাই হয়ে উঠছে অভদ্র, অশোভন, অমার্জিত ও নিষ্ঠুর।
শিশুরা যে সমাজে বেড়ে উঠছে সেখান থেকে তারা মানবতার শিক্ষা পাচ্ছে না। মানুষ হবার প্রেরণা পাচ্ছে না। সুনাগরিক হয়ে উঠবার শিক্ষা পাচ্ছে না। শুধু নিজ দেশে নয়, বিশ্ব পরিস্থিতিও আজ কোনো দেশে, কোনো সমাজে একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠার অনুকূলে নয়। সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিদিন যা দেখি কিংবা আমাদের শিশুরা যা দেখছে, যুদ্ধের ভয়াবহতা, নিষ্ঠুরতা, তাতে একটি শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং সহজেই একটি শিশুর মন ও মনন থেকে মানবতাবোধ, মমত্ববোধ লোপ পাচ্ছে।
সমাজে কোথাও কোনো সুবাতাস নেই। সুখবর নেই। বড়দের দলাদলি, মারামারি, স্বার্থপরতা, মিথ্যাচার, নিষ্ঠুরতা, প্রতারণা দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে শিশুরা। আর এর প্রভাবেই ওই শিশুরাও বড় হয়ে অবচেতনে একই আচরণ করছে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, নিজ সন্তানদের প্রতি, নিজ পাড়ার শিশুদের প্রতি আস্থা রাখতে পারি না। দলবদ্ধ কিশোর-তরুণ, যাদের শরীর থেকে এখনো মাতৃদুগ্ধের গন্ধ দূর হয়নি তাদের দেখে ভয়ে-আতঙ্কে সিঁটিয়ে যাই। কারণ এখন এই কিশোর-তরুণরাই যেন আমাদের সকল দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেপরোয়া এই কিশোর-তরুণদের কাছে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্র প্রশাসনও যেন অসহায় হয়ে পড়েছে।
কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য, সুখী দেশের তালিকা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই) প্রতিবেদন-২০২৩ বলছে, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তালিকায় গত বছর বায়ুদূষণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ, আর ঢাকা ছিল শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত জাতীয় জরিপ (২০১৮, ২০১৯ সাল) বলছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের ১৯ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের ১৩ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ২০ মার্চ আন্তর্জাতিক সুখ দিবস উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। গত ৪ এপ্রিল ওই দৈনিকের প্রকাশিত ‘মতামত’ পাতায় ‘উন্নয়ন সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন সুখহীনতায়’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামও এই বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেন। তিনি লিখেছেন, “এ প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত ১৪৩টি দেশের তালিকায় ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ রয়েছে ১২৯তম অবস্থানে। আর বাংলাদেশের স্কোর হলো ১০-এর মধ্যে ৩.৮৮৬। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১১৮। সে হিসাবে এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১১ ধাপ পিছিয়েছে।”
তিনি আরও লিখেছেন, “মানুষকে সুখী করার পেছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি একটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতেও থাকতে পারে সুখী হওয়ার উপাদান। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফিনল্যান্ডের মানুষের সুখী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সান্নিধ্য, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন, সুখ নিয়ে বেশি চিন্তা না করা, হতাশাবাদী না হওয়া, আভিজাত্যের প্রতিযোগিতা বা বহিঃপ্রকাশ না করে অনাড়ম্বর বা সাদামাটা জীবন যাপন করা।”
২. অপরাধের ক্ষেত্রে কিশোর অপরাধ বা গ্যাং কালচার নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা বিশ্বে গত শতকে নগরায়ণের ফলে এই সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। আমাদের দেশে নগরায়ণের কুফল হিসেবে কেউ কেউ এটিকে দেখলেও পুরোটা সত্য নয়। কারণ কিশোর-তরুণদের এই বেপরোয়া আচরণ গ্রামাঞ্চলেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
আমাদের সন্তানদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা চাই, খেলার মাঠ চাই বলছি বটে কিন্তু ওই খেলার মাঠও যদি সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধির বদলে রক্তারক্তির ঘটনার জন্ম দেয় তাহলে দেশের কয়েক কোটি কিশোর-তরুণদের বিনোদন, ক্রীড়ার ব্যবস্থা কী করে হবে? নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে? সমাজে এই যে ক্ষয় ধরেছে, আমাদের সন্তানরা যে দিন দিন নিষ্ঠুর ও অমানবিক হয়ে উঠছে এর কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতামত এক্ষেত্রে খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।
চট্টগ্রামের একটি ঘটনা। কয়েকদিন আগে মোবাইলে লুডু খেলার সময় তর্কাতর্কি থেকে একে অপরকে থাপ্পর মেরেছিল। এর কয়েকদিন পর প্রতিশোধ হিসেবে খুন করা হয় তাকে। এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটছে দেশে। চট্টগ্রামেই ক্রিকেট খেলার সময় তর্কাতর্কি থেকে খুনের ঘটনাও ঘটেছে।
সমাজকে নিরাপদ না করে পুলিশ প্রহরায় তো খেলা থেকে বিনোদন পাওয়া সম্ভবপর নয়। এ ধরনের ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বলে চালিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে খেলার মাঠে গিয়ে কাউকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। এই ঘটনাগুলো সমাজের অবক্ষয়ের চিত্র। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুব সহসাই খুঁজে বের করতে হবে।
কিশোর তরুণদের হিরোইজম নতুন কিছু নয়। খেলাধুলা বা নানা বিষয়ে আগেও বিভিন্ন সময়ে মারামারি-কলহ হয়েছে। তবে তখন তা মাঠ থেকে আর বেশি দূর বিস্তৃত হয়নি। এখন সামান্য চড়-থাপ্পরের প্রতিক্রিয়ায় যদি খুনোখুনির মতো ঘটনা ঘটে তবে তা সমাজের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। আমাদের সময়ে কিংবা আমাদের আগে বা পরেও শিশু-কিশোরদের মনে হিরোইজম ছিল না তা নয়। কখনো খেলার মাঠে মারামারি হয়েছে। তবে তা মাঠের বাইরে আসেনি খুব একটা। পাড়ায়-পাড়ায় মারামারিও হয়েছে তবে তা হকিস্টিক, লাঠি, চাকু, রিকশার চেইন কখনো কখনো ‘মাছ মার্কা’ ছুরি পর্যন্ত গড়িয়েছে। সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে খুনখারাবি খুব একটা ঘটেনি আমাদের সময়ে। কথা কাটাকাটি বা মারামারির সময়ে পাড়ার কোনো গুরুজনকে দেখে থমকে গেছে সবাই, পালিয়ে গেছে হিরোরা। সমাজের সর্দাররা মিলে কলহ মিটিয়ে দিয়েছে। সালিশ-বৈঠক করে দুপক্ষকে মিলিয়ে দিয়েছে। এখন ওই সমাজবদ্ধতা নেই, সামাজিক অনুশাসন নেই। পরস্পরকে মান্য করার প্রবণতাও নেই।
বয়স্ক, গুরুজনদের সে সম্মান এখন দখল করেছে বড়ভাইয়েরা। যারা এদের শাসন করার পরিবর্তে উস্কানি ও প্রশ্রয় দিচ্ছে। প্রায় দুগ্ধপোষ্য শিশুদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিচ্ছে। অপরাধ সংঘটিত করার পর এই পিচ্চি অপরাধীরা ওই বড় ভাইদের কাছে আশ্রয় নিচ্ছে। বড় ভাইয়েরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে এই অপরাধীদের লালন করছে। আর বড় ভাইয়েরা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। নেতাদের আনুকুল্য পাচ্ছে।
রাজনীতি বলুন আর ধর্মীয় আচার বলুন কোথাও আজ মানবিক শিক্ষা প্রদানের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। নৈতিক শিক্ষা, সততার শিক্ষা, উদার ও মানবিক হওয়ার শিক্ষা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘৃণা ছড়াবার বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। মিথ্যা, বানোয়াট, অতিরঞ্জিত তথ্যের ভিড়ে প্রকৃত সত্যটি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় ট্রলের শিকার হতে পারেন। ট্রলকারীরা জানেই না তার একটা বিদ্রুপের কারণে একজন মানুষ কীভাবে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারেন।
ক্ষুদ্র মানুষগুলো সবসময় চেষ্টা করে তার চেয়ে উচ্চতায় থাকা মানুষটিকে টেনেহিঁচড়ে কী করে তার সমান্তরালে নামিয়ে আনবে। মানুষের বড় দুঃসময় আজ। এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে আমাদের।