শতকোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে গা-ঢাকা দিয়েছেন চান মিয়া সওদাগরের উত্তরসূরি

 

পূর্বপুরুষের সুনাম এবং পারিবারিক ও ব্যবসায়িক ঐতিহ্যকে পুঁজি করে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে শাহাদাত বিন আশরাফ সাইমুন নামের এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। এতে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় দেড় শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।চট্টগ্রামের খ্যাতিমান চান মিয়া সওদাগরের উত্তরসূরি এ ব্যবসায়ী বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানান ।

খাতুনগঞ্জের প্রথম দিকের ব্যবসায়ী চান মিয়া সওদাগর পরিচিত ছিলেন ‘চট্টগ্রামের হাতেম তাই’ হিসেবে। ১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহণকারী এ ব্যবসায়ী তত্কালীন সময়ে শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার, দানশীলতার জন্য বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। তারই প্রপৌত্র শাহাদাত বিন আশরাফ সাইমুনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছেলের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার কারণে সাইমুনের পিতা-মাতাও এখন দেশের বাইরে গা-ঢাকা দিয়েছেন।

শাহাদাত বিন আশরাফ পড়াশোনা করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর দেশে এসে পারিবারিক সুনামকে পুঁজি করে নিজস্ব ব্যবসা শুরুর চেষ্টা করেন। এ পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রতারণার পথ বেছে নেন তিনি। এরপর পরিচিতজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সহায়তায় খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন তিনি। এরপর ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন তিনি। এক্ষেত্রে পারিবারিক ঐতিহ্য ও পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দেখিয়ে তিনি ভুক্তভোগীদের আস্থা অর্জন করেন। ব্যবসায়িক পার্টনার বানানোর পর তাদের কাছ থেকে চুক্তির ভিত্তিতে অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি। এরপর পাওনা ফেরত দেয়ার জন্য বিভিন্ন দিক থেকে চাপ এলে ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যস্থতায় অর্থ ফেরতের আশ্বাস দেন সাইমুন। পরবর্তী সময়ে অর্থ ফেরত দেয়ার পরিবর্তে আত্মগোপনে চলে যান সাইমুন।

ব্যবসায়ীরা জানান, খাতুনগঞ্জে চান মিয়া সওদাগরের নামডাককে কাজে লাগিয়ে এখানকার ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে প্রতারণা শুরু করেন সাইমুন। এরপর সহযোগী পার্টনারদের মাধ্যমে খাতুনগঞ্জে সিন্ডিকেট ব্যবসা, স্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক বৃহৎ শিল্পগ্রুপগুলোর সঙ্গে আমদানি-রফতানির ব্যবসার তথ্য প্রচার করে মাসিক ভিত্তিতে লভ্যাংশ প্রদানের শর্তে টাকা নেন তিনি। শুরুতে বেশ কিছুদিন নিয়মিত লভ্যাংশও দিয়েছিলেন তিনি। এভাবে লগ্নিকারীদের আস্থা অর্জনের পর তাদের লগ্নির পরিমাণ বৃদ্ধিতে প্ররোচিত করেন। সর্বশেষ গত বছরের আগস্টের পর লভ্যাংশ প্রদান অনিয়মিত হয়ে পড়লে লগ্নিকারীরা সাইমুনের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ পর্যায়ে এসে সাইমুন গা-ঢাকা দেন।

২০১৯ সালে চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাওনা ৩৩ লাখ টাকা আদায়ে মামলা (সিআর মামলা নং-৪৭৫/২০১৯, চকবাজার) করেন লাভলেনের ব্যবসায়ী ও গ্রীনকনের স্বত্বাধিকারী মো. বোরহান। গত বছরই তিনি বাদী হয়ে ৮ কোটি টাকা আদায়ের জন্য সাইমুনের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা (সিআর মামলা নং-৭৬৭/২০১৯, পাঁচলাইশ) করেন। এর বাইরেও ১ কোটি ১ লাখ টাকা আদায়ের জন্য আরো দুটি (সিআর মামলা নং-১৯১/২০২০, চকবাজার ও সিআর মামলা নং-৪৭৪/২০১৯, চকবাজার) মামলা করেন মো. বোরহান। এছাড়াও সাইমুনের পিতা মো. আশরাফ আলীর বিরুদ্ধে একই বাদী ২ কোটি ৩২ লাখ টাকার একটি সিআর মামলা দায়ের করেন (মামলা নং-৪৩৭/২০১৯, চকবাজার)। এ পাঁচ মামলায় মোট ১১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তোলা হয়েছে সাইমুনের বিরুদ্ধে। সবগুলো মামলাতেই সাইমুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। যদিও অভিযুক্ত সাইমুন এখনো পলাতক রয়েছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বাদী মো. বোরহানকে হুমকিসহ ভয়ভীতি প্রদর্শন ও চাঁদা দাবির অভিযোগে আরো একটি মামলা (মামলা নম্বর-১৪৫/২০২০, সিএমএম আদালত) করা হয়। ওই মামলাতেও সাইমুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

জানতে চাইলে ভুক্তভোগী মোহাম্মদ বোরহান  বলেন, পারিবারিক ঐতিহ্যকে পুঁজি করে শাহাদাত বিন আশরাফ সাইমুন দেড় শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। আমার কাছ থেকে টাকা নেয়া ছাড়াও আমার ব্যবসায়িক পরিচিতিকেও কাজে লাগিয়ে অন্যান্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে আত্মসাৎ করেছেন চান মিয়া সওদাগরের প্রপৌত্র সাইমুন। চেক প্রতারণাসহ বিভিন্ন জালিয়াতির কারণে তার বিরুদ্ধে আমি মোট ছয়টি মামলা দায়ের করেছি। আরো অর্ধশতাধিক পাওনাদার এখন আমাকেই সাইমুনের অর্থ আত্মসাতের জন্য দায়ী করছেন।

খাতুনগঞ্জের চাক্তাইয়ে মো. সুমন নামের একজন চাল ব্যবসায়ীকে নিজের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে তার কাছ থেকেও ২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সাইমুনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে একই কায়দায় মোহাম্মদ করিম সাজিদ নামে আরো একজনের কাছ আরো প্রায় ১ কোটি টাকা আত্মসাতেরও। সুমন ও সাজিদ উভয়েই সাইমুনের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার অভিযোগে একাধিক মামলা দায়ের করেছেন। অভিযোগকারীরা বলছেন, সব মিলিয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার দেড় শতাধিক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শতকোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন সাইমুন।

জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম সংগঠক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে সাইমুন চট্টগ্রামজুড়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। খাতুনগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী সাইমুনের ব্যবসা ও সিন্ডিকেটে বিনিয়োগ করেছিলেন বলে শুনেছি। ব্যবসায়ীদের নিজেদের লেনদেনের বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা হবে। তবে সাইমুনের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থাকা এবং খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সাইমুনের কোনো সদস্যপদ না থাকায় এসব বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন কোনো দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবে না।

খাতুনগঞ্জে এভাবে বারবার প্রতারণার ঘটনা ঘটার পেছনে এখানকার অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন পদ্ধতিকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা জানান, খাতুনগঞ্জে অপ্রাতিষ্ঠানিক লেনদেন মাধ্যম হিসেবে টু-টু খুবই জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে মূলত বিশ্বাসের ভিত্তিতে বড় অংকের সুদের বিনিময়ে সপ্তাহ/মাসের জন্য অর্থঋণ দেয়া হয়। খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন বড় ব্যবসায়ী, ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান নগদ অর্থের লেনদেনে এ প্রাচীন রেওয়াজ অনুসরণ করছে। ডিও লেনদেনে হঠাৎ নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে ব্যাংকের পরিবর্তে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন ব্যবসায়ীরা। খুবই জনপ্রিয় এ পদ্ধতিতে ডিও ব্যবসায়ীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারায় ভোগ্যপণ্যের দামের ওঠানামায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে অস্বাভাবিক ক্রয়প্রবণতার মাধ্যমে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বড় অংকের মুনাফার সুযোগ থাকায় বেআইনি হলেও পদ্ধতিটি এখনো খাতুনগঞ্জে টিকে আছে। ফলে এখানে এ ব্যবসায় বিনিয়োগের কথা বলে সহজেই অর্থ সংগ্রহ ও প্রতারণার সুযোগও বেশি।

সাইমুনের পিতা আশরাফ আলীর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা এলাকায় আশরাফিয়া লাইব্রেরি নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। সাইমুন ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। এরপর ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পর ২০১১ সালে দেশে ফিরে আসেন। তার মা জোবাইদা আশরাফ বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী। দেশের বেশ কয়েকটি রাঁধুনি প্রতিযোগিতায় জোবাইদা আশরাফ সেরা রাঁধুনির পুরস্কারও পেয়েছিলেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি রান্নাবিষয়ক রিয়েলিটি শোর বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।