হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে ডাকা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটিতে বেজে উঠেছে ভাঙনের সুর। প্রয়াত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অনুসারীদের এ সম্মেলনে দাওয়াত দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। শফী অনুসারীরা সম্মেলনকে অবৈধ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সম্মেলন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। সম্মেলনের মাধ্যমে হেফাজতকে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ। এছাড়া আল্লামা শফীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা কারা হয়েছে অভিযোগ করে তারা এর বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। শফী অনুসারীরা আলাদাভাবে হেফাজতের কর্মকাণ্ড চালাতে পরেন বলেও আভাস মিলেছে।
তবে সম্মেলন আয়োজনকারী অংশটি বলছে, গুটিকয়েক বিতর্কিত নেতার বিরোধিতার মুখে সংগঠনটির তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। সম্মেলনের মাধ্যমে যাদের নির্বাচন করা হবে, তাদের নেতৃত্বে সংগঠনটি আগের মতোই ঐক্যবদ্ধ থাকবে বলে তারা আশাবাদী।
আজ চট্টগ্রামের হাটহাজারী আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় এ প্রতিনিধি সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১০ সালে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক আলোচিত সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে মাদ্রাসাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন। ইতোমধ্যে সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটি ও শূরা কমিটির সদস্য, কওমি ঘরানার শীর্ষ আলেম-ওলামাসহ প্রায় ৫০০ জনকে সম্মেলনে দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শনিবার হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামবাদী যুগান্তরকে বলেন, সম্মেলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আজকের সম্মেলনে উপস্থিত আলেম-ওলামারা যাদের দায়িত্ব দেবেন, তারাই হেফাজতে ইসলামের নতুন আমীর নির্বাচন করবেন। প্রয়োজন হলে তারা আরও কিছু পদে পরিবর্তন এনে কমিটি পুনর্গঠন করতে পারেন।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত হেফাজতের নতুন আমীর হিসেবে বর্তমান মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীর নামই এককভাবে আলোচনায় রয়েছে। আর কেউ এখনও এ পদের জন্য আগ্রহ দেখাননি। জুনায়েদ বাবুনগরী আমীর নির্বাচিত হলে মহাসচিব পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
তবে সম্মেলনবিরোধীরা এরই মধ্যে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দিন রুহী। তিনি প্রকাশ্যেই সম্মেলনের বিরোধিতা করছেন। সম্মেলনবিরোধী অংশটি হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে। এতে লিখিত বক্তব্যে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছোট শ্যালক মাওলানা মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন বলেন, রোববার (আজ) কাউন্সিলের ডাক দেয়া হয়েছে। প্রতিনিধি কাউন্সিলের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে হুজুরের (আহমদ শফী) গড়া সংগঠনকে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অবিলম্বে এ সম্মেলন বন্ধ করতে হবে। এ সময় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহীসহ শফী অনুসারী বেশ ক’জন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন জানান, হুজুরের স্ত্রী ফিরোজা বেগম অসুস্থ থাকায় তার অনুরোধে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া আল্লামা শফীর ছেলে আনাস মাদানী হত্যার হুমকি পেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাই তিনি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি।
আল্লামা শফীকে জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মারা হত্যা করেছে দাবি করে মঈন উদ্দীন এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়েছেন। তিনি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি করে হেফাজতে ইসলামের কাউন্সিল বন্ধের আহ্বানও জানান।
তিনি বলেন, আল্লামা আহমদ শফী প্রকাশ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেন এবং তাদের বিরুদ্ধে বইও লিখেছেন। এ কারণে শফী হুজুরের প্রতি জামায়াত-শিবিরের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভ থেকে এই হত্যাকাণ্ড। শফী হুজুরকে হত্যার উদ্দেশ্যে এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য জামায়াত-শিবির ১৯৮৫ সালে হামলা চালিয়েছিল। দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও কওমিদের প্রতি ভালোবাসা থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ হামলা রুখে দিয়েছিলেন আহমদ শফী।
শাপলা চত্বরে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ফাঁদে পা না দেয়ার কারণে শফী হুজুরকে তখন থেকেই হত্যার পরিকল্পনা করা হয় দাবি করে তিনি বলেন, ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় কিছু ছাত্রকে উসকে দিয়ে জামায়াত-শিবিরের লেলিয়ে দেয়া ক্যাডার বাহিনী মাদ্রাসা অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসায় অবস্থান নিয়ে মীর ইদ্রিছ, নাছির উদ্দিন মুনীর, মুফতি হারুন ও ইনজামুল হাসানদের দিয়ে সেখানে লুটতরাজ ও ভাংচুর চালায়। এ সময় বিভিন্ন ধর্মীয় বইয়েও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
তিনি বলেন, ওই সময় জোরপূর্বক হুজুরের কক্ষে প্রবেশ করে ভাংচুর এবং হুজুরকে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে শফী হুজুরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এতে হুজুর অসুস্থ হয়ে পড়লে মুখে অক্সিজেন দেয়া হয়। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের প্রেতাত্মারা অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। পরে অ্যাম্বুলেন্স আনা হলেও তারা ঠিক সময়ে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়তে দেয়নি।
এদিকে সম্মেলন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী যুগান্তরকে বলেন, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তত ৬০ জনকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। যারা আহমদ শফীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত, তাদের কমিটি থেকে বাদ দিতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রুহী জানান, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নীতি-আদর্শে বিশ্বাসীরাই হেফাজতে ইসলাম। অন্যরা হেফাজতে ইসলাম নয়। আহমদ শফীর আদর্শের নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠকের পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
এদিকে রুহীর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী জানান, হেফাজতের ১৫১ সদস্যের কমিটির প্রায় সবাইকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আনাস মাদানীকে বিভিন্ন অভিযোগে হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি মাদ্রাসায় এলে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। এজন্য তাকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। শফী হুজুরের আরেক ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
চরমোনাই পীরের অনুসারীদের দাওয়াত প্রসঙ্গে আজিজুল হক বলেন, তারা প্রথমদিকে হেফাজতের সঙ্গে থাকলেও পরে আর সক্রিয় থাকেননি। তিনি বলেন, মঈনুদ্দীন রুহী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, আনাস মাদানীসহ ৫-৬ জন সম্মেলনের বিরোধিতা করছেন। সংগঠনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। হেফাজতের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছেন এবং থাকবেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবেও শফী অনুসারীদের সংবাদ সম্মেলন : শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবেও সংবাদ সম্মেলন করেন আল্লামা শফীর অনুসারীরা। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। তিনি বলেন, একটি চিহ্নিত মহল হেফাজতে ইসলামকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে গভীর ষড়যন্ত্র করছে। মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হেফাজতের কাউন্সিলের নামে একতরফাভাবে কাউকে দায়িত্ব দিলে তা এ দেশের ওলামায়ে কেরাম মেনে নেবে না। ভিন্নপথে কোনো কিছু করার ষড়যন্ত্র করা হলে তা দেশবাসী রুখে দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, হেফাজতের মূল প্রতিষ্ঠাতা, উদ্যোক্তা, যাদের শ্রম ও ঘামে হেফাজতে ইসলাম এ পর্যন্ত এসেছে, তাদের বাদ দিয়ে নতুন কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ও মহলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চক্রান্ত কওমি অঙ্গনের জন্য ভবিষ্যতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।