মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসেও বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চাই , সহজলভ্য হোক করোনার ওষুধ-
“অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া এক মাকে মোটর সাইকেলে বসিয়ে বাইকের সাথে সিলিন্ডার বেঁধে হাসপাতালে হাসপাতালে সন্তানের ছুটে চলার একটি ছবি মানুষকে আপ্লুত করেছে, শংকিত করেছে। মাত্র ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলে অভাগী মায়ের কি হবে!!”
এটিই করোনার একমাত্র দৃশ্য নয়, আরো নানা দৃশ্য আছে। ছবি আছে, কাহিনী, গল্প আছে। আছে একেবারে নিরবে নিশব্দে নি:শেষ হয়ে যাওয়ার নির্মম ঘটনাও।
দেশে অগুনতি মানুষ প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেকে পরীক্ষা করতে পারছেন, অনেকে পরীক্ষা করাতেই যাচ্ছেন না। কারো মাঝে উপসর্গ আছে, কারো মাঝে কিছুই নেই। শত শত রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ঘরে, পরিচিত চিকিৎসকদের পরামর্শে। আবার বহু রোগী ছুটছেন হাসপাতালে। আইসিইউ তো দূরের কথা, সাধারণ একটি বেডের অভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন মানুষ।কোভিড পরিস্থিতি এমন যে, হাজার হাজার রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন না, যেতে হচ্ছে না। আবার শারিরীক জটিলতা নিয়ে শত শত মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। হওয়ার সুযোগ খুঁজছেন, চেষ্টা করছেন। গবেষনায় এসেছে, হাসপাতালে ভর্তির ৫ দিনের মধ্যেই মরে যাচ্ছেন ৪৮ শতাংশ রোগী। উপসর্গ প্রকাশের ১০ দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন৩৮ শতাংশ মানুষ। প্রতি ১২.৮ মিনিটে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছেন দেশে।কথা বলতে বলতেই মূহুর্তে একজন মানুষের অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়া এবং আইসিইউ, হাইফ্ল্যো ন্যাজল ক্যানোলা কিংবা লাইফ সাপোর্ট হয়ে কবরে চলে যাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন, করছে বাধ্য হচ্ছেন।
একথা ঠিক যে, ভয়াল এবং অচিন করোনার সুনিশ্চিত কোন চিকিৎসা পৃথিবীতে এখনো নেই, সবই গবেষনা। সবই চিকিৎসকদের অর্জন। কিন্তু মানুষের এই মৃত্যুর কাফেলা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। কবে হবে তাও অজানা। কোন ওষুধে কাজ করবে, কোন ওষুধ আদৌ কাজ করবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও বিভিন্ন ধরনের দেশী বিদেশী ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। সুফলও মিলছে। মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। আবার সব ধরনের চিকিৎসা এবং ওষুধ ব্যবহার করেও মারা যাচ্ছেন অনেকেই। প্রতি ১২.৮ মিনিটে একজন!!!
ভয়াল কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার জন্য মানুষের আকুতি স্বাভাবিক। কিন্তু এই সুস্থ হতে গিয়ে কতজন যে তাদের পরিবার পরিজনকে পথে বসিয়ে দিচ্ছেন সেই গল্প ঠিকঠাকভাবে প্রকাশ হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষই জানেন না। একজন কোভিড রোগী আইসিইউ বা লাইফ সাপোর্টে থাকলে তার চিকিৎসা ব্যয় কোত্থেকে কিভাবে মেটানো হচ্ছে সেই খবর অধিকাংশ সময়ই তার জানার কথা নয়। জানার মতো পরিবেশও থাকে না। নিজেদের প্রিয়জনকে ধরে রাখার জন্য স্বজনদের আহাজারী আইসিইউর বাইরেও যে কিভাবে হাহাকার তোলে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হচ্ছে, নানাভাবে চেষ্টার পরও প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছেন, কবরে যাচ্ছেন। শুধু নিজেই কবরে যাচ্ছেন না, নিজের অজান্তেই পুরো পরিবারকে কবরের পাড়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। আবার নানা শারিরীক জটিলতা থেকে অনেকেই সুস্থ হচ্ছেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরো পরিবারই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একবারে খাদের কিনারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এখানেই আমি এবং আমরা তাকিয়ে আছি আপনার দিকে।
আবারো বলছি করোনা চিকিৎসায় সবার অবস্থা খারাপ হচ্ছে না। কিছু মানুষের হচ্ছে। এই সংখ্যা কিন্তু কম নয়। বিভিন্ন গবেষনায়ও এই সংখযাটি উদ্বেগের মনে হয়েছে। যাদের বাঁচানোর জন্য দেশী বিদেশী নানা ওষুধ প্রয়োগ করতে হচ্ছে। এসব ওষুধ করোনা হানা দেয়ারও বহু আগে থেকে ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সারসহ নানা চিকিৎসায় ব্যবহৃত অতি দামী ওষুধগুলোর প্রয়োগ ভয়াল এই দুর্দিনে মানুষকে পথ দেখাচ্ছে, আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু সব মানুষ এই আলো পাচ্ছেন না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। পেলেও নিজের পরিবার পরিজনকে একেবারে নি:স্ব করে দিয়ে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন। আর যারা সব হারিয়ে মরে যাচ্ছেন তারা মনে হয় বেঁচে যাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন যে, কোভিড চিকিৎসায় সিরিয়াস রোগীদের ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের রোচ কোম্পানির তৈরি বিশেষ দুইটি ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। এ্যাক্টেমেরা নামের এই ইনজেকশনের ৪০০ এমজির দাম দেশে ৪৩ হাজার টাকা, ২০০ এমজির দাম ২১ হাজার পাঁচশ টাকা। সুইজারল্যান্ড থেকে রেডিয়েন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড এই ওষুধ আমদানি করে। চিকিৎসকদের প্রথম পছন্দ এ্যাক্টেমেরা ইনজেকশন হলেও রেডিয়েন্ট তা যোগান দিতে পারে না। দেশে কোথাও স্বাভাবিক ভাবে এ্যাক্টেমেরা ইনজেকশন পাওয়ার সুযোগ নেই, অতি প্রভাবশালীদের কথা জানি না। তবে মোটামুটি প্রভাবশালী বা সাধারণ কেউ এ্যাক্টেমেরা ইনজেকশন পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের একই কোম্পানির তৈরি এবং বাংলাদেশেও একই কোম্পানির আমদানিকৃত অনেক দামের এভাসটিন ইনজেকশন পাওয়া যায়। তবে দাম দিয়েও তা সহজ প্রাপ্য নয়। নানা তদবির এবং চেষ্টায় যোগাড় করতে হয় এই এভাসটিন ইনজেকশন। ৪০০ এমজির প্রতিটি ইনজেকশনের দাম ৭৮ হাজার টাকা, ১০০ এমজির ২০ হাজার টাকা। কোন কোন সময় আরো বাড়তি দিয়েও এভাসটিন ইনজেকশন কিনতে হয়, কিনতে বাধ্য হল স্বজনেরা। শারিরীক ওজন হিসেব করে প্রয়োগ করা হয় এভাসটিন। কাউকে একটি, কাউকে দুইটি। এক্ষেত্রে মোটামুটি ওজনের একজন মানুষের লাখ খানেক টাকা প্রথম ঝটকায় বের হয়ে যায় যদি এভাসটিনের মতো ইনজেকশন দিতে হয়। স্বজনকে বাঁচাতে মরিয়া মানুষের কাছে তখন বিশাল অংকের এই টাকার চেয়ে এভাসটিন পাওয়াটাকেই পরম সৌভাগ্য মনে করা হয়।
আপনি জানেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুধু এভাসটিন দিয়ে তো আর চিকিৎসা হয় না। রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে সেজন্য নাভিতে সকাল সন্ধ্যা ইনজেকশন পুশ করা হয়, দেশী বিদেশী। এক একটি ইনজেকশনের দাম ৫/৭শ টাকা। একজন রোগীকে ২৫/৩০টি ইনজেকশন দিতে যে পরিমান খরচ হয় তা দেশের বহু সাধারণ মানুষেরই যোগাড়ের সাধ্য নেই। শুধু কি ইনজেকশন? সাথে আইসিইউ, অক্সিজেন বিল, বিভিন্ন টেস্ট এবং অন্যান্য খরচ মিলে যা দাঁড়ায় তা বহন করা সত্যিই কঠিন। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হলেও আনুষাঙ্গিক বহু খরচই রোগীদের স্বজনদের বুকে পাথরের মতো চেপে বসে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকারিভাবে হাসপাতালে এভাসটিন বা এ্যাক্টেমেরা দেয়া সম্ভব নয়। তবে দেশীয় তৈরি রেমডেসিভির ইনজেকশন দেয়ার কথা। দেয়াও হতো। দুইটি ইনজেকশন একই নয়, কাজও সমান নয়। তবুও যাদের ফুসফুস অন্তত ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে রেমডেসিভির ইনজেকশন দেয়া হতো। কিন্তু চট্টগ্রামে সরকারিভাবে কোথাও তা আর ফ্রি পাওয়া যাচ্ছে না। বন্ধ হয়ে গেছে। কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের ছয় ভায়াল রেমডিসিভির ইনজেকশন দিতে হয়। সরকারিভাবে পাওয়া না গেলেও বাজারে দেশীয় কোম্পানির এই ওষুধ মিলে। খোলা বাজার থেকে যা কিনতে ২০ হাজার টাকার মতো লাগে। সাধারণ একজন শ্রমজীবি খেটে খাওয়া মানুষ, সাধারণ চাকুরীজীবি কিংবা মধ্যবিত্ত একজন মানুষ যিনি গত এক বছরেরও বেশী সময় যুদ্ধ করছেন কোনরকমে টিকে থাকার জন্য তারপক্ষে কী এত টাকার ইনজেকশন কিনে সরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব? যদি একই পরিবারে একাধিক মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হন!!!
করোনায় জটিল হওয়া রোগীরা সুস্থ হলেও তাদের অন্তত তিনমাস হার্ট এ্যাটাকসহ বিভিন্ন ঝুঁকি থাকে। দেখা দেয় কিংবা বেড়ে যায় ডায়াবেটিস। লিভারসহ শরীরে তৈরি হয় জটিলতা। রক্ত পাতলা রাখার ইনজেকশন বা ট্যাবলেটসহ নানা ওষুধে থাকতে হয় সুস্থ হয়েও অসুস্থ মানুষগুলোকে। আর এই বেঁচে থাকার পুরেটাই শুধু টাকা আর টাকা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কোভিড চিকিৎসার দামি ইনজেকশন ছাড়াও আরো যে কত খরচ!! বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানলাম তাতে দিনকয়েক আইসিইউসহ একটু কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হলে গড়ে পাঁচ থেকে বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত বিল উঠছে। যার একটি বড় অংশ ওষুধ এবং টেস্টের।কোভিড চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলো যেভাবে ভূমিকা রাখছে তা বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু ইনজেকশন এবং ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে সবাইকেই প্রায়ই একই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যারা বেশী দামে ওষুধ কিনতে পারছেন তারা যুদ্ধ করতে পারছেন। যারা পারছেন না তাদের অনেকেই নিদারুণভাবে আত্মসমপর্ণ করছেন, হারিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি ১২.৮ মিনিটে একজন!!!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিদেশী ওষুধ ফ্রি পাওয়ার আশা কেউ করবে না। ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে অনেক দামী এই ওষুধের ট্যাক্স ভ্যাট সার্ভিস চার্জও খুব বেশী নয় বলে জানালো রেডিয়েন্ট, ওষুধটিই দামী। সিংগাপুর বা আমেরিকায় নাকি আরো অনেক বেশী দামে বিক্রি হয়। আমাদের মনে হয়, আমদানিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনা বা ভর্তুকির মাধ্যমে এভাসটিনসহ অন্যান্য ওষুধের দাম যদি সহনীয় করা যেতো তাহলে দেশের বহু মানুষই খাদে পড়া থেকে নিস্তার পেতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি অতি ব্যয়বহুল কোভিড টেস্ট সাধারণের জন্য ফ্রি করে দিয়েছেন। অতি মূল্যবান টিকাও ধনী গরীব সবার জন্যই ব্যবস্থা করেছেন ফ্রি।অশেষ কৃতজ্ঞতা আপনি এবং আপনার সরকারের প্রতি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকা নানা পন্থায় লোপাটও হয়েছে। ক্যাসিনোকান্ডসহ নানা খাত থেকে প্রচুর অর্থ সরকার জব্দ করেছে। চোরাচালানের কয়েক হাজার মন স্বর্ণ দেশের ভল্টে আছে। শুধু উন্নয়নশীল দেশই নয়, দারুণ এক তেজীভাব আমাদের রিজার্ভে। পদ্মা ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্প হাতছানী দিচ্ছে আমাদের। কিন্তু দেশে প্রতি ১২.৮ মিনিটে একজন করে মানুষ মারা গেলে মেট্রোরেলে কে চড়বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
মানুষের জন্য উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু করোনার ওষুধ সহজলভ্য এবং সস্তা করে মানুষ বাঁচানো আরো বেশী দরকার। করোনার ওষুধ সহজলভ্য করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মারাত্মক শারিরীক জটিলতা নিয়েও একজন মানুষও যেন ওষুধ এবং চিকিৎসার অভাবে মারা না যান, একটি পরিবারও যেন পড়ে না যায় খাদে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার হাতে আমার প্রিয় স্বদেশ। আমি এবং আমরা নিশ্চিন্তে নিশ্বাস ফেলতে চাই। নিতে চাই খাদের পাড়ে চলে যাওয়া অগুনতি মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস থেকে বুক ভরা নিশ্বাস।